বারো মাসই হাওর একসময় ছিল জীবনের উৎসব। আষাঢ়ের কালো মেঘ জমলেই হাওরের মানুষ জানত—বাইরা এসে গেছে। গান, কিচ্ছার আসর, নাইওরীর দিন এসেছে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি—বাড়ির চৌকাঠে নৌকা ভিড়ত।
হেমন্তে বাতাসে ধানের গন্ধ, শীতে পাখির ডানার ছায়া—সব মিলিয়ে হাওর ছিল জীবনের এক অবিনাশী উৎসব। আশ্বিন,কার্তিকের দুপুরে মাছ ধরতে গেলে করচ-হিজলের ঝোপে হাত দিলেই পাওয়া যেত পুটি, টেংরা, কই, বাইমসহ নানা জাতের মাছ। মাত্র কুড়ি মিনিটেই এক পরিবারের খাবার পরিমাণ মাছ ধরা যেত।
আষাঢ়-শ্রাবণে নদী-খাল ভরে পানি নামত, উজানের স্রোতে বড় বড় বোয়ালের পাল ভেসে আসত। বৃষ্টি আর বজ্রের মধ্যে মানুষ বেরোত ‘উজাই মারা’। পলোবাওয়া, দড়াটানা, ডাকবান্দা, কুচাশিকার, আলোয়ারা, খাঞ্জাহিচা—এসব ছিল স্থানীয় মানুষের তৈরি পরিবেশবান্ধব মাছ ধরার পদ্ধতি। কোনো প্রযুক্তি নয়, কোনো বিষ বা কারেন্ট জাল নয়—সুনামগঞ্জের স্থানীয় নামের এসব পদ্ধতিতে ছিল শুধু মানুষের বুদ্ধি ও প্রকৃতির মেলবন্ধন।
কিন্তু এখন সেই হাওর আর নেই। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, খাল ভরাট হয়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হচ্ছে, মাছ হারিয়ে গেছে, পাখিরা নিখোঁজ। হাওর ঘিরে যে নদী, খাল, বিল একসময় ছিল প্রাণের উৎস, এখন তা হয়ে উঠছে মৃত্যুর প্রতীক। আধুনিক কারেন্ট জাল, নিষিদ্ধ মাছ ধরার যন্ত্র, জলমহালে ইজারাদারের রাক্ষসী থাবা—সব মিলে মাছের বংশ প্রায় শেষ। হাওরের বর্তমান প্রজন্ম এখন ‘অছু’, ‘রুঙ্গা’, ‘কুচা’, ‘বেলঝাল’, ‘পুটিটান’—এসব নামের সঙ্গেও অপরিচিত।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা—সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া—মিলে গঠিত বিশাল হাওরাঞ্চল। একসময় হাওরের সংখ্যা ছিল ৪১২টি, এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭৩। প্রায় দুই কোটি মানুষ সরাসরি নির্ভর করে আছে এই হাওরের জল, মাছ, পাখি ও বনজ সম্পদের ওপর। হাওরাঞ্চলে প্রায় ৮.৬৯ লাখ হেক্টর স্থায়ী জলাশয় আছে, যা বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া প্রায় ছয় হাজার মৌসুমি বিল-ঝিল শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। প্রতিটি জলাশয়ের সঙ্গে নদী বা খালের সংযোগ ছিল, কিন্তু উজানের পলি পড়ে এবং অপরিকল্পিত বাঁধ-সড়ক নির্মাণে সেই সংযোগ ছিন্ন হয়েছে।
একসময় হাওর ছিল জলজ উদ্ভিদরাজির স্বর্গভূমি। হিজল, করচ, বরুণ, জারুল, মেরা—শুধু গাছ নয়, হাওরের প্রাণের শ্বাস। পানির নিচে জন্মাত ক্যাটেরোফাইলাম, হাইড্রিলা, খাসোরধাম; ভাসত কচুরিপানা, খুদেপানা। নলখাগড়া, বেত, ফুটকি, কলমি, দুর্বা, হেলেঞ্চা, সিংরা, শালুক—সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য জীববৈচিত্র্যের বৃত্ত তৈরি করেছিল। এই উদ্ভিদগুলো শুধু সৌন্দর্যের নয়—জলজ প্রাণীর আশ্রয়, মাছের ডিম ছাড়ার জায়গা, পাখির খাদ্যভূমি। কিন্তু এখন সেই ঝোপঝাড়, নলখাগড়া আর হিজল-করচবন কেটে ফেলা হয়েছে বাঁধ, ঘরবাড়ি আর রাস্তার নিচে।
সন্ধ্যা নামলে একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে দেশি-বিদেশি পাখি হিজল, করচ আর বাঁশঝাড়ে এসে বসত। তাদের ডানার ঝাপটা আর কিচিরমিচির ছিল হাওরের ঘড়ি—সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সংকেত। শীতকালে ছিল আরও প্রাণচাঞ্চল্য—দেশি পাখির সঙ্গে আসত হাজারো পরিযায়ী পাখি। টাঙ্গুয়ার হাওরে একসময় বছরে গড়ে দুই লাখ পাখির আনাগোনা ছিল, এখন সেটা কমে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার, বনভূমি ধ্বংস, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া—সব মিলে পাখির বাসস্থান নিশ্চিহ্ন। পাখির অনুপস্থিতিতে হাওরের ভোরও আর আগের মতো জেগে ওঠে না।
ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীর মধ্যে ২৪টি নদী ও খাল দিয়ে হাওরে প্রবেশ করেছে। এই নদীগুলোর তলদেশ এখন পলিতে ভরাট। উজানের পাহাড়ি ঢল নিয়ে আসে পলি ও বালু, যা হাওরের বিল ও খালগুলোকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছে। আশির দশক থেকে যোগাযোগের নামে হাওরের বুক চিরে রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের পরিকল্পনায় ছিল না পানি প্রবাহের কথা। ফলে প্রাকৃতিক জলচক্র ভেঙে গেছে, মাছের প্রজননস্থল ধ্বংস হয়েছে, জলজ উদ্ভিদের আবাস হারিয়েছে।
একসময় যে হাওরে ছিল ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছ, তার মধ্যে ৫৪টি এখন বিলুপ্তির পথে। এখানে ২৫৭ প্রজাতির পাখি ছিল—১২৯ দেশি, ১২৮ বিদেশি। ৯ প্রজাতির উভচর, ৪০ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হাওরের ইকোসিস্টেমের অংশ ছিল। এখন অনেক প্রজাতিই আর দেখা যায় না। হাওর থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪.৩২ লাখ টন মাছ আহরিত হতো—যা দেশের অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ। এখন সেই পরিমাণ দ্রুত কমছে। জলজ উদ্ভিদের অনেক প্রজাতি—যেমন হাইড্রিলা, হেলেঞ্চা, ফুটকি—হ্রাস পেয়েছে; শামুক, ঝিনুক, কাফনা, লাখি মাছ প্রায় বিলুপ্ত। গরু ও হাঁস পালনের সংস্কৃতিও কমে গেছে, কারণ প্রাকৃতিক খাদ্য নেই।
হাওরের ইকোসিস্টেম ধ্বংসের কারণ একক নয়, এটা এক জটিল জাল। উজানের পলি পড়ে নদী ভরাট হচ্ছে, পানি প্রবাহ ব্যাহত। যোগাযোগের উন্নয়নের নামে রাস্তা, সেতু, বাঁধ তৈরি করে হাওরের শ্বাসরোধ করা হচ্ছে। হিজল, করচ, বেতবন উজাড় হয়ে যাওয়ায় পাখি ও মাছের আশ্রয় নেই। ধান চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার জলজ প্রাণীকে হত্যা করছে। বিষটোপ দিয়ে পাখি মারা, কারেন্ট জালে মাছ ধরা, প্রজননকালে মাছ নিধন—এসব নিধনযজ্ঞে ভারসাম্য পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এদিকে বারবার ফসলহানিতে মানুষ হাওরের সব সম্পদকে টিকে থাকার উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে, কিন্তু তা হয়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত ও ধ্বংসাত্মক।
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত হাওরের জীবন ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্র এক দশকে প্রকৃতির ভারসাম্য পাল্টে গেছে। যে জল একসময় ছিল জীবনের প্রতীক, এখন তা অনেক সময় হয়ে ওঠে মৃত্যুর কারণ—অতিরিক্ত বন্যা বা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া। হাওরের মানুষ এখন দ্বৈত সংকটে—প্রকৃতি ও নীতি উভয় দিক থেকেই অবহেলিত। তারা বুঝে গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কেউ জিততে পারে না।
হাওর বাঁচাতে এখনই দরকার বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরকে সক্রিয় করতে হবে, যাতে তারা কেবল কাগজে নয়, মাঠে কাজ করে। নদী ও খাল খনন করে পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিষটোপ ও অবৈধ জাল ব্যবহারে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। জলমহাল ইজারা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, হাওরপাড়ের মানুষের বিকল্প জীবিকা ও টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব পর্যটন, পাখি ও মাছ সংরক্ষণের জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক প্রহরী দল গঠন করা জরুরি।
হাওর শুধু ভূগোল নয়—এটা আমাদের আত্মার জলাভূমি, আমাদের সংস্কৃতির জলের আয়না। এখানেই জন্মেছে আমাদের গান, গল্প, নদী ও নদীর সন্তানরা। এই হাওর মরলে শুধু পাখি-মাছ নয়, মরবে বাংলাদেশের এক বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও। “নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল”—এই প্রবাদ এখন শুধু স্মৃতির গল্প হয়ে যাচ্ছে। হাওর বাঁচাতে পারলে শুধু প্রকৃতি নয়, টিকে থাকবে এই দেশের আত্মাও।
এসএন