ঢাকার সঙ্গে দিল্লির উত্তেজনার পারদ চড়ছে, অন্যদিকে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্কে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর খবর যোগ করছে বাড়তি মাত্রা।
ভারতের মূল ভূখণ্ডকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেছে মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডোর। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে কৌশলগত অবস্থানে থাকা ভূখণ্ডটি এর সংকীর্ণ আকৃতির কারণে ‘চিকেনস নেক’ নামেও পরিচিত। ভারতের সবচেয়ে সংবেদনশীল ভূ-রাজনৈতিক বিন্দুগুলোর একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয় এই করিডোরকে।
চলতি সপ্তাহেই ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, শিলিগুড়ি করিডোরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কৌশলগত পয়েন্টে তিনটি সামরিক গ্যারিসন স্থাপন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
ভারতীয় কর্মকর্তারা নতুন সামরিক ব্যবস্থার খুঁটিনাটির ব্যাপারে নীরব থাকলেও ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ এবং মোতায়েন শক্তিশালী করার যথেষ্ট প্রমাণ দেখা গেছে।
১৫ বছরের শাসনামলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল সম্পর্ক নিশ্চিত করেছিলেন। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুতির প্রেক্ষাপটে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক আর যাই হোক, বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের শক্তি প্রদর্শন
নয়াদিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ)-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান হর্ষ ভি.পন্ত বলেছেন, শিলিগুড়ি করিডোর একটি ‘কৌশলগত দুর্বলতা যা ভারতকে রক্ষা করতে হবে।’
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল শান্তি পুরষ্কার জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের কথা উল্লেখ করে পন্ত বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাব ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইউনূস সরকার নয়াদিল্লির প্রতি অনুকূল নয়।’
৯ নভেম্বর উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামে ভারতের বিমানবাহিনী তাদের সর্ববৃহৎ বিমান প্রদর্শনীও করেছে। মহড়াটি নিয়মিত আয়োজনের অংশ হলেও ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এয়ার শো এর একটি হওয়ায় এটিকে অনেকেই একটি বার্তা হিসাবে দেখতে চাচ্ছেন।
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে যখন ভারতের সামরিক প্রদর্শনী চলছে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর তখন অবস্থান করছে পাকিস্তানের একটি যুদ্ধজাহাজ। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে নোঙর ফেললো। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর প্রধানও একই সময়ে ছিলেন বাংলাদেশ সফরে।
পন্ত বলেন, ভারত ধারাবাহিক সামরিক মহড়ার মাধ্যমে ইঙ্গিত দিতে চায় যে ‘এই অঞ্চলে তারা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, সে সম্পর্কে দেশটি সচেতন।’ তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, বিমান প্রদর্শনীটি ‘বিশেষ করে কোনো কিছুকে লক্ষ্য করে আয়োজন করা হয়নি।’
অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্যের মতও প্রায় একই। তিনি বলেন, কখনো কখনো এগুলো নিয়মিত মহড়া, কখনো কখনো কৌশলগত সংকেত। তবে তিনি মনে করেন, উদ্দেশ্য রাতারাতি বদলে যেতে পারে। বিশ্বাস নষ্ট হলে আজকের বন্ধু আগামীকালের প্রতিপক্ষও হয়ে উঠতে পারে।
তলানিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক
পন্ত মনে করছেন, ভারতের সামরিক পদক্ষেপগুলো প্রতিরক্ষামূলক এবং সংঘাতের উদ্দেশ্য নয়। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্যের কারণে উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে মার্চ মাসে ইউনূসের দেওয়া একটি মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করেন পন্ত। চীনে এক আলোচনায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ‘স্থলবেষ্টিত’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র প্রবেশদ্বার বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ঢাকা পরবর্তীতে এক ব্যাখ্যায় বলেছে, আঞ্চলিক সংযোগের সম্ভাবনাকে তুলে ধরাই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তবে অঞ্চলটির ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে এই ব্যাখ্যাকেও নয়াদিল্লি ভালোভাবে নেয়নি।
সাম্প্রতিক সামরিক ঘটনাবলী নিয়ে দুই সরকারই নীরব ভূমিকায় রয়েছে।
ভারতের পক্ষ থেকে বরাবারই বার্তা দেয়া হচ্ছে যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালটা তারা ‘অপেক্ষা’ করেই কাটিয়ে দিতে চায়। বিভিন্ন বার্তায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর ভারত ‘নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে’ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
‘একবার নির্বাচন হয়ে গেলে এবং ম্যান্ডেটসহ একটি সরকার আসার পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া শুরু হতে পারে,’ মনে করেন পন্ত।
বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়ার কারণ কী!
২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
১৫ বছরের শাসনামলে হাসিনা ভারত-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়া, জঙ্গিবাদ দমন এবং যোগাযোগ উন্নয়ন প্রকল্পে ভারতকে সহায়তা করেছিলেন। এসব সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার দেয়া এবং চার হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা।
তবে দুই দেশের সম্পর্কে অবিশ্বাসও উসকে দিয়েছে নানা ঘটনা। ভারতের ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-র মাধ্যমে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে অনেকেই এই ঘটনাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখেননি।
বাংলাভাষী অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করে দেয়া ভারতীয় নেতাদের নানা বক্তব্যও এই শত্রুতাকে আরো গভীরভাবে উসকে দিয়েছে। এর পাশাপাশি সীমান্তে হত্যা, অভিন্ন নদীর জলবণ্টন চুক্তিতে ব্যর্থতাসহ আরো নানা সংকটও বিরোধিতাকে তীব্রতর করেছে।
পতনের পর পালিয়ে যাওয়া হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশে এই ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক মনোভাব আরো প্রকট হয়েছে। ঢাকার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে নীরব রয়েছে।
ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার একের পর এক সাক্ষাৎকার দেয়ার ঘটনাকেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উসকানি হিসাবে বিবেচনা করছে।
১২ নভেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় দূতকে তলব করে হাসিনার গণমাধ্যমে উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। গত বছর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে শেখ হাসিনার। এ বিষয়ক প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করা হবে ১৭ নভেম্বর।
সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক এম. হুমায়ুন কবির বলেন, ১৫ বছর ধরে ভারতের এমন বিশ্বাস হয়েছে যে তারা চাইলেই ঢাকাকে ‘নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে’। সেই সময় এখন আর নেই। বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা তীব্রতর হয়েছে।
পাকিস্তান-বাংলাদেশ ‘নতুন পাওয়া ভালোবাসা’
একদিকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে এসেছে নতুন উষ্ণতা, যাকে ওআরএফ- এর পন্ত উল্লেখ করেছেন, ‘নতুন পাওয়া ভালোবাসা’ হিসাবে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত কূটনৈতিক ও সামরিক দুই দিক থেকেই সহায়তা করেছিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ককে উষ্ণতায় ফেরানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তান।
ইসলামাবাদ তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং গোয়েন্দা প্রধানসহ উচ্চ পর্যায়ের নানা প্রতিনিধিদল ঢাকায় পাঠিয়েছে, বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং নৌসফর ও প্রতিরক্ষা আলোচনার মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতাও পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের ভারতের প্রভাব মোকাবিলার প্রচেষ্টার অংশ, তবে নয়াদিল্লি এই সম্পর্ককে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে।
‘বাংলাদেশ সবসময়ই ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার কথা স্বীকার করে এসেছে’ বলে জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশি জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর। তিনি বলেন, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নিজের স্বার্থকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ভারতের কাছে মাথা নত করবে।
সাবেক কূটনীতিক কবির মনে করেন বাংলাদেশ ‘ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তি খুব ভালো করেই বোঝে’। তবে দুই দেশের সম্পর্কে যে ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমতা এবং মর্যাদা’ প্রয়োজন, ভারতের পক্ষ থেকে তার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের আমন্ত্রণে ১৯ নভেম্বর নয়াদিল্লি যাচ্ছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। ভারত মহাসাগরীয় পাঁচ দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সম্মেলন - কলম্বো নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিবেন তিনি। তীব্র উত্তেজনার মধ্যে এই সফরের সময়কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
ইএ/টিকে