পাকিস্তানের সংবিধান পরিবর্তন, সেনাপ্রধান পেলেন গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন মুক্তি

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট। একই সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার, মামলা ও বিচার প্রক্রিয়া থেকে আজীবন দায়মুক্তিও প্রদান করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা আরো জোরালো করবে।

নতুন সংশোধনীর ফলে ২০২২ সাল থেকে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আসিম মুনির এখন পাকিস্তানের নৌ ও বিমান বাহিনীরও তদারকির ক্ষমতা পাবেন।

তার ফিল্ড মার্শাল পদবি আজীবনের জন্য বহাল থাকবে এবং অবসর পরেও রাষ্ট্রপতির নির্দেশে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকবে—যা তাকে জনপরিসরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবশালী ভূমিকা নিশ্চিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী কার্যকর হয়েছে। এই আইনে শুধু সেনাবাহিনী নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতগুলোর কাঠামোতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকারি পক্ষের দাবি, সংশোধনীটি সশস্ত্র বাহিনীর প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং আদালতে মামলার জট কমাতে সহায়তা করবে।

তবে সমালোচকদের মতে, এটি বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সামরিক প্রভাবও বাড়িয়ে দেবে।
দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে—কখনও সরাসরি অভ্যুত্থান, আবার কখনও পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। জেনারেল জিয়া-উল-হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামল এর স্পষ্ট উদাহরণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন পাকিস্তানে যে ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থা চলছিল, এই সংশোধনীর ফলে তা আরো একধাপ সামরিক আধিপত্যের দিকে এগিয়ে গেল।

যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মন্তব্য করেন, পাকিস্তান এখন ‘পোস্ট-হাইব্রিড’ ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে, যেখানে বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট।

সরকার সমর্থিত সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ মনে করেন, আধুনিক যুদ্ধের চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রতিরক্ষা কাঠামো উন্নত করতেই এই পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেছেন, বেসামরিক ও সামরিক ক্ষমতার ভারসাম্য পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে—যে সময় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমানোর প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সময়ই তাদের আরও শক্তিশালী করা হলো।

২৭তম সংশোধনীর আরেকটি বিতর্কিত দিক হলো একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠন, যা সাংবিধানিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দেবে। এর বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি—যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে।

মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেন, এই পরিবর্তন ন্যায্য বিচারের অধিকারকে বিপন্ন করবে। সাংবাদিক আরিফা নূরও মনে করেন, বিচার বিভাগ এখন কার্যত নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

অনেক আইনজীবী বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে সাংবিধানিক মামলার চাপ কমাতে এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, কারণ দেশের অধিকাংশ মামলা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন।

সংশোধনী কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি আথার মিনাল্লাহ ও মনসুর আলী শাহ পদত্যাগ করেন। তারা অভিযোগ করেন, বিচার বিভাগকে দুর্বল করে সংবিধানকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এ সংশোধনীর ফলে বিচারকদের সম্মতি ছাড়াই বদলি করা সম্ভব হবে। বদলিতে আপত্তি জানালে তিনি কমিশনে আপিল করতে পারবেন, কিন্তু আপত্তি অযৌক্তিক হলে তাকে অবসরে যেতে হবে।

সমালোচকদের মতে, সরকার এতে বিচারকদের ওপর চাপ বাড়াতে পারবে। আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগ অতীতে স্বৈরশাসকদের সঙ্গে সমঝোতা করলেও, মাঝে মাঝে নির্বাহী বিভাগকে চ্যালেঞ্জ জানাত। কিন্তু নতুন পরিস্থিতি জনআস্থাকে আরও সংকটে ফেলবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের এই পরিবর্তন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে এবং দেশকে আরও কর্তৃত্ববাদী পথে ঠেলে দিতে পারে। ইতোমধ্যেই ২৮তম সংশোধনী আনার জল্পনাও শুরু হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা। 

এবি/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের বাজারে সুখবর Nov 15, 2025
img
শেকড় ভুলে না যাওয়ার শিক্ষা স্মরণ করালেন অভিনেতা ভিকি কৌশল Nov 15, 2025
img
বাড়ছে না সরকারি এলপিজির দাম Nov 15, 2025
img
১৭ বছর শেখ হাসিনার আমলে ভারত কিছু দেয়নি, বরং নিয়ে গেছে : মির্জা ফখরুল Nov 15, 2025
img
দিল্লিতে বসে হাসিনা জ্বালাও-পোড়াওয়ের হুকুম দিচ্ছেন: ফখরুল Nov 15, 2025
img
আবেগের ঝড় তুলে এলো তেরে ইশ্‌ক মেঁ- এর ট্রেলার Nov 15, 2025
img
'স্পিরিট'-এ প্রভাস আসছে নতুন লুকে Nov 15, 2025
img
জামায়াতসহ আরও ১২ দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ সোমবার Nov 15, 2025
img
গত ১৪ মাসে সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে, হায় আল্লাহ এটা কী হলো : গোলাম মাওলা রনি Nov 15, 2025
img
‘সাইয়ারা’ সিনেমার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনে অভিভূত পরিচালক Nov 15, 2025
img
ফিটনেসে অনুপ্রেরণা পেয়েছি ধর্মেন্দ্র থেকে: সালমান Nov 15, 2025
img
দ্বিতীয় মৌসুমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখবেন হীরামণ্ডির নারীরা Nov 15, 2025
লক্ষাধিক রুশ বোমার উৎপাদনে চাপে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা Nov 15, 2025
মামদানির প্রতি নিউইয়র্কবাসীর আস্থা, প্রশাসনে যোগ দিতে ৫০ হাজার আবেদন Nov 15, 2025
একসময় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সংগঠনই নষ্ট করত শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার : ফরহাদ Nov 15, 2025
img
ভিজয় দেবরকোন্ডার প্রশংসায় আবেগতাড়িত রাশমিকা মন্দানা Nov 15, 2025
img
কোনো অপশক্তিই নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না : আইজিপি Nov 15, 2025
img
পাথিরানাকে ছেড়ে দিল চেন্নাই সুপার কিংস Nov 15, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত ফরোয়ার্ডকে নিয়ে বাংলাদেশে আসছে ভারত Nov 15, 2025
পিরোজপুরে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে অগ্নিকাণ্ড! ঘটনায় ক্ষোভে/ ফুঁসছে সাধারণ মানুষের Nov 15, 2025