বিশ্বজুড়ে আকাশপথে প্রবেশ নিষিদ্ধ কিছু এলাকায়!

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন কিছু সংবেদনশীল এলাকা রয়েছে, যেগুলোর ওপর দিয়ে বিমান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিস্ময়ের বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের ডিজনিল্যান্ডের আকাশসীমাও এর ব্যতিক্রম নয়। ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনিল্যান্ড-উভয় থিম পার্কের ওপরে আকাশ নো-ফ্লাই জোন হিসেবে চিহ্নিত।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে বিভিন্ন দেশের সরকার স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বিমান চলাচলে এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। এসব নির্দিষ্ট এলাকাকে বলা হয় ‘নো-ফ্লাই জোন’। বিশ্বজুড়ে বিমান চলাচলের নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং সংরক্ষণযোগ্য অঞ্চলগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে এই ধরনের বিধিনিষেধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পার্থক্যের জায়গা

আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা মূলত দুই ধরনের নো-ফ্লাই জোন এবং নিষিদ্ধ আকাশসীমা। এই দুইয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নো-ফ্লাই জোন মূলত সামরিক কারণে আরোপিত হয় এবং সাধারণত সংঘাতপূর্ণ বা যুদ্ধাবস্থার অঞ্চলে কৌশলগতভাবে প্রয়োগ করা হয়। ইতিহাসে এর বেশ কিছু উদাহরণ আছে যেমন ২০১১ সালে লিবিয়ায় নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করা হয়েছিল। আবার ২০২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের আকাশসীমাও সাময়িকভাবে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়।

এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা শুধু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেই নয়, জননিরাপত্তা বা সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। এমনকি অলিম্পিকের মতো বড় বেসামরিক আন্তর্জাতিক ইভেন্টেও সাময়িক নো-ফ্লাই জোন প্রয়োগ করা হতে পারে।


নিষিদ্ধ আকাশসীমা সাধারণত নিরাপত্তাজনিত কারণে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়। উড্ডয়ন মানচিত্রে এসব এলাকা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত থাকে। কোনো বিমান ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে এই সংরক্ষিত আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে প্রথমে তাকে রেডিওর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়। পরিস্থিতি গুরুতর হলে পরবর্তী ধাপে সামরিক বাধা প্রদান বা প্রয়োজনে আক্রমণসহ আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

বিশেষ ধরনের জায়গার আকাশসীমাকে ‘নিষিদ্ধ আকাশ সীমা’ ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে আছে-

ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও পবিত্র স্থান

পৃথিবীর প্রাচীন ও পবিত্র স্থাপনাগুলোর পরিবেশ ও স্থাপত্যকে সুরক্ষিত রাখতে অনেক অঞ্চলের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পেরুর মাচু পিচু এর অন্যতম উদাহরণ-

ঐতিহ্যবাহী ইনকা সভ্যতার অনুপম নিদর্শন এই শহরের ওপর ২০০৬ সাল থেকে আকাশপথে উড্ডয়ন সম্পূর্ণ বন্ধ। পঞ্চদশ শতকের এই ঐতিহাসিক স্থানের ওপর নিষিদ্ধ আকাশসীমা ঘোষণা করার লক্ষ্য হলো-কম উচ্চতায় হেলিকপ্টার চলাচল বন্ধ করে দর্শনার্থীদের শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, পাশাপাশি স্থানীয় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদরাজিকে সুরক্ষিত রাখা।

ইসলামের পবিত্র নগরী সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনার আকাশসীমা বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিবছর হজ পালনে আসা লাখ লাখ মুসলিম তীর্থযাত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ধর্মীয় পবিত্রতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মদিনায় মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আকাশপথ থেকে নজরদারি চালানো হয়।

ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হওয়ার সুবাদে ভারতের তাজমহলসহ সংখ্যাধিক প্রাচীন ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূৰ্ণ স্থাপনার ওপর ২০১৯ সাল থেকে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাজমহলের পাশাপাশি দেশজুড়ে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের আকাশসীমা সংরক্ষিত- যেমন রাজধানী নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন, মুম্বাইয়ের ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ এবং ধর্মীয়ভাবে পবিত্র তিরুমালা ভেঙ্কটেশ্বরা মন্দির, পদ্মনাভস্বামী মন্দির ও গোল্ডেন টেম্পল।

গ্রিসের ঐতিহাসিক স্থাপনা পার্থেননের আকাশসীমায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে-সেখানে ৫ হাজার ফুটের নিচে কোনো বিমান ওড়ার অনুমতি নেই। ঐতিহ্য সংরক্ষণ, দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সংবেদনশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সরকারি স্থাপনা

প্রতিটি দেশই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আকাশসীমা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি সে ধরনের একটি বিশেষ ফ্লাইট রুলস এরিয়া (Special Flight Rules Area)। এর একটি ৩০ মাইল ব্যাসার্ধের বাইরের বলয় এবং একটি ১৫ মাইল বা ২৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের ভেতরের বলয় রয়েছে। ভেতরের অঞ্চলটি ফ্লাইট রেস্ট্রিকটেড জোন-যেখানে কিছু নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক ফ্লাইট ছাড়া অন্য কোনো বিমান বা ড্রোন প্রবেশ করতে পারে না। বিশেষভাবে, হোয়াইট হাউসের ওপর দিয়ে উড্ডয়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অবকাশ যাপন কেন্দ্র মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিড এবং টেক্সাসের প্যান্টেক্স নিউক্লিয়ার অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টের আকাশসীমাও কঠোরভাবে সংরক্ষিত। একইভাবে জর্জিয়ার নেভাল সাবমেরিন বেস কিংস বে এবং ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের নেভাল বেস কিটসাপের ওপর দিয়েও কোনো ধরনের বিমান উড্ডয়ন অনুমোদিত নয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে রাজপরিবার ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সুরক্ষার জন্য আকাশসীমা নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। বাকিংহাম প্যালেস, উইন্ডসর ক্যাসল, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ডাউনিং স্ট্রিট এবং হাউসেস অব পার্লামেন্টের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ইসরাইলের নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার, ইসরাইলি এয়ার ফোর্সের সাদত মিকা এয়ারবেস, আল-আকসা মসজিদসহ তিনটি স্থান আকাশপথের হুমকি থেকে সুরক্ষিত। চলমান আরব-ইসরাইলি সংঘাতের কারণে কিছু দেশের বিমানকেও ইসরাইলি আকাশসীমায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

বাণিজ্যিক ও সামরিক কৌশলগত সীমাবদ্ধতা

নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা বা সামরিক নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় বৃহৎ এলাকাজুড়ে আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়। ৯/১১ হামলার পর ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনিল্যান্ড এবং ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড-উভয়কেই যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা আকাশসীমা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব পার্কের তিন মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো ধরনের বিমান উড়তে পারে না।

নিরাপত্তার পাশাপাশি আরেকটি কারণ হলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের বিমানবাহিত বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখা, যাতে পার্কের পরিবেশ ও দর্শনার্থীদের ‘ম্যাজিকাল অভিজ্ঞতা’ অক্ষুণ্ণ থাকে।

আলোর শহর প্যারিসে ৬,৫০০ ফুট বা ২,০০০ মিটারের নিচের উচ্চতায় সব ধরনের বিমান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে কিউবার আকাশসীমায় অনুমতি ছাড়া প্রবেশকারী যেকোনো বিদেশি বিমানকে কঠোর প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হতে পারে। চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ওপর দিয়ে উড্ডয়নও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট রুটে চীনা আকাশসীমা ব্যবহার করলেও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।

সংঘাত ও প্রাকৃতিক বিপদের কারণে নিষেধাজ্ঞা

২০২২ সালে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের আকাশসীমা বেসামরিক বিমানের জন্য সীমিত রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা না হলেও বেসামরিক উড়ান প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনার কারণে অনেক বেসামরিক এয়ারলাইনসকে রাশিয়ার আকাশসীমা এড়াতে বলা হয়েছে। একইভাবে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের কারণে উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমাও নিরাপদ নয়, ফলে সেখানে বিমান চলাচল প্রায় নিষিদ্ধ।

সূত্র: স্টার্স ইনসাইডার

আরপি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

সেনা সংকট চরমে: ইউক্রেনীয় বাহিনীতে পলাতক-অনুপস্থিত ৩ লাখ Dec 11, 2025
২০২৫ সাল হবে বিশ্ব ইতিহাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় উষ্ণতম বছর Dec 11, 2025
img
মেট্রোরেলের ভ্যাট প্রত্যাহার Dec 11, 2025
img
‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলা শিক্ষককে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ধাওয়া Dec 11, 2025
img
তফসিলে সন্তুষ্ট বিএনপি, এতে ভোটের অধিকার বাস্তবায়ন হবে: মির্জা ফখরুল Dec 11, 2025
img
নির্বাচনে প্রতি উপজেলায় কাজ করবেন ২ জন ম্যাজিস্ট্রেট Dec 11, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন অভিনেত্রী ওয়েন অ্যালটন Dec 11, 2025
img

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর Dec 11, 2025
img
সবার সহযোগিতায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পেয়েছি : প্রধান বিচারপতি Dec 11, 2025
img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ২ দিন সর্বসাধারণের প্রবেশ বন্ধ Dec 11, 2025
img
১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন Dec 11, 2025
img
গৌরব খান্নার সঙ্গে প্রেম গুঞ্জনের জবাবে মুখ খুললেন অনুপমা’র নিধি Dec 11, 2025
img
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করছেন সিইসি Dec 11, 2025
img
পুলিশের ৮ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বদলি Dec 11, 2025
img

প্রেস সচিবের কড়াবার্তা

তফসিল ঘোষণার পর রাস্তায় নামলে কঠোরভাবে দমন করা হবে Dec 11, 2025
img
হিলের জুতা এখন আমার সবচেয়ে বড় ভয় : মিথিলা Dec 11, 2025
img
ডিপজল থাকতেন তিনতলায় মাকে রাখতেন কাজের মেয়ের সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে Dec 11, 2025
img
খালেদা জিয়া বেঁচে থাকলে গণতন্ত্র মজবুত থাকবে : এ্যানি Dec 11, 2025
img
বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার Dec 11, 2025
img
জোট করলেও নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, হাইকোর্টের রায় Dec 11, 2025