কঠোর বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন থাকা পরে গত প্রায় তিন দশকের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে ভয়াবহ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে সিডনির আইকনিক বন্ডি বিচে এক ইহুদি উৎসবে। রোববার হানুক্কাহ উৎসবের প্রথম দিনে এই হামলায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশ সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) জানিয়েছে, দুই হামলাকারী ছিলেন বাবা-ছেলে।
নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ কমিশনার মাল ল্যানিয়ন জানিয়েছেন, নিহত একজন বন্দুকধারী হলেন ৫০ বছর বয়সি সাজিদ আকরাম, যাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। অন্য বন্দুকধারী হলেন তার ২৪ বছর বয়সি ছেলে নাভিদদ আকরাম, যিনি আহত অবস্থায় বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সিবিএস নিউজ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, বাবা-ছেলে সম্ভবত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। বাবার ড্রাইভিং লাইসেন্সের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাকে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের জার্সির মতো দেখতে একটি সবুজ শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি বার্ক জানিয়েছেন, ছেলে নাভিদ অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া নাগরিক। বাবা সাজিদ ১৯৯৮ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় আসেন, যা ২০০১ সালে পার্টনার ভিসায় এবং পরে রেসিডেন্ট রিটার্ন ভিসায় রূপান্তরিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ নিশ্চিত করেছেন, হানুক্কাহ উৎসবের প্রথম দিনে হামলাকারীরা ইহুদি সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে হামলা চালিয়েছে।
ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা আইএএনএস জানিয়েছে, ছয় বছর আগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে সম্পর্ক থাকার সন্দেহে অস্ট্রেলিয়ান গোয়েন্দারা নাভিদকে পরীক্ষা করেছিলেন। যেহেতু সে নজরদারির অধীনে এসেছিল, তাই ধরা এড়াতে সে লুকিয়ে ছিল এবং হামলার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।
তদন্তকারীদের মতে, সাজিদ আকরামের একটি ফলের দোকান ছিলো এবং তার ছেলে একটি কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই মাস আগে রাজমিস্ত্রির চাকরি হারিয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে, সাজিদের প্রায় ১০ বছর ধরে বন্দুকের লাইসেন্স ছিল।
গ্রীষ্মের শেষ দিনে যখন হাজার হাজার মানুষ বন্ডি বিচে ভিড় করেছিল তখনই সহিংসতা শুরু হয়। ‘হানুক্কাহ বাই দ্য সি’ ইভেন্টের জন্য সেখানে শত শত ইহুদি ধর্মাবলম্বী জড়ো হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রায় ১০ মিনিট ধরে হামলা চলে, যার ফলে শত শত মানুষ সৈকতে ও সংলগ্ন রাস্তাগুলোতে ছুটতে শুরু করে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৬:৪৫ মিনিটের দিকে জরুরি পরিষেবা ডাকা হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, সাঁতারের পোশাকে থাকা মানুষজন গুলির শব্দ শুনে পানি থেকে উঠে দৌড়াচ্ছে। অন্য একটি ফুটেজে দেখা যায়, কালো শার্ট পরা দুই ব্যক্তি একটি ফুটব্রিজ থেকে বন্দুক দিয়ে গুলি চালাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশনে প্রচারিত একটি নাটকীয় ক্লিপে দেখা যায়, আহমেদ আল আহমেদ নামের এক ফলের দোকানের মালিক এক বন্দুকধারীকে ঝাপটে ধরে নিরস্ত্র করছেন এবং পরে সেই বন্দুকটি তার দিকে তাক করে মেঝেতে নামিয়ে রাখছেন।
নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার ক্রিস মিনস এই ব্যক্তিকে ‘প্রকৃত নায়ক’ আখ্যা দিয়েছেন। এই সাহসিকতার জন্য তার জন্য খোলা একটি তহবিল পৃষ্ঠায় সোমবার সকালের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ডলার সংগৃহীত হয়।
মিনস সাংবাদিকদের জানান, নিহতদের বয়স ১০ থেকে ৮৭ বছরের মধ্যে। সোমবার সকালে কমপক্ষে ৪২ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের ধর্মীয় প্রচারক অর্থোডক্স ইহুদি আন্দোলন চাবাদ নিশ্চিত করেছে যে, নিহতদের মধ্যে একজন হলেন অনুষ্ঠানের আয়োজক ও চাবাদ অফ বন্ডির সহকারী রাব্বি এলি স্লাঙ্গার।
অস্ট্রেলিয়ায় গণগুলি চালানো খুবই বিরল ঘটনা। ১৯৯৬ সালে তাসমানিয়ার পোর্ট আর্থারে ৩৫ জন নিহত হওয়ার পর রোববারের এই হামলাটিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ সোমবার সকালে বন্ডি বিচ পরিদর্শন করেন এবং ঘটনাস্থলের কাছে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তিনি এই হামলাকে জাতির জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, আমরা যা দেখেছি, তা ছিল বিশুদ্ধ শয়তানি কাজ, একটি ইহুদিবিরোধী কাজ, একটি সন্ত্রাসী কাজ।
অস্ট্রেলিয়ায় বাবা-ছেলের বন্দুক হামলায় নিহত ১৫, আহত ৪২অস্ট্রেলিয়ায় বাবা-ছেলের বন্দুক হামলায় নিহত ১৫, আহত ৪২
আলবানিজ জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁসহ বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং সংহতি প্রকাশ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
এই ভয়াবহ ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হামলা। এটি অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলের গাজা যুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ায় ঘটে যাওয়া সিনাগগ, ভবন ও গাড়িতে ইহুদিবিরোধী হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এসএন