বিভিন্ন লেখালেখিতে শরিফ ওসমান হাদি নিজেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাকে বাবা আব্দুল হাদির কবরের পাশেই দাফন করা হয়। তবে পরিবার জানিয়েছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র নিলে তারা সেটিই মেনে নেবে।
হাদির ভগ্নিপতি আমির হোসেন বলেন, ‘হাদি এখন আর শুধু আমাদের নয়, তিনি রাষ্ট্রের সম্পদ। রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটাই গ্রহণ করব। আমাদের একটাই চাওয়া, হাদির স্মৃতি যেন হারিয়ে না যায়। দেশের প্রতি তার এই আত্মত্যাগের কথা যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।’
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় হাদির গ্রামের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আজ শুক্রবার সকালে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। হাদির বড় বোনের স্বামী নলছিটি ফুলহরি আব্দুল আজিজ দাখিল মাদরাসার সুপার ও বাইপাস সড়কে আশরাফ আলী হাওলাদার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আমির হোসেন।
তিনি জানান, হাদির পৈতৃক বাড়ি নলছিটির হাড়ড়িখালী গ্রামে। সেখানেই তার বাবা শায়িত আছেন। পরে খাসমহলে প্রায় চার দশক আগে বাড়ি করা হয়, যেখানে হাদির এক বোন বসবাস করতেন।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি। শুক্রবার রাত থেকেই খাসমহল এলাকায় হাদির বাড়িতে ভিড় করেন স্বজন, অনুসারী, বন্ধু ও পাড়াপ্রতিবেশীরা। কান্না, বিস্ময় আর অবিশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।
হাদির আকস্মিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এলাকার মানুষ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যাকে দেখেছেন। হাদির কণ্ঠে শুনেছেন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল লড়াই আর ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ডাক।
জুলাই যোদ্ধা হাদির এমন পরিণতি বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। বাড়িতে আসা অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্মৃতিচারণে উঠে আসে হাদির দৃঢ়তা, সরল জীবনযাপন আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থানের কথা। পরিবার ও স্বজনদের দাবি একটাই, হাদিকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
অনুসারীরাও বলছেন, হাদির শুরু করা লড়াই কোনো মৃত্যুতেই থেমে যাবে না। ন্যায়বিচারের দাবিতে তারা সোচ্চার থাকার অঙ্গীকার জানান। এদিকে হাদির মৃত্যুর ঘটনায় ঝালকাঠিসহ বরিশাল বিভাগজুড়ে বাদ জুমা দোয়া মাহফিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম শরিফ ওসমান হাদির। তার বাবা ছিলেন একজন মাদরাসাশিক্ষক। পারিবারিক আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা হাদির জীবন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ।
হাদির শিক্ষাজীবনের সূচনা ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদরাসায়। সেখান থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
ছাত্রজীবন শেষে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন হাদি। শুরুতে একটি স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এক সন্তানের জনক হাদির জীবন আবর্তিত হতো পরিবার, শিক্ষকতা আর জ্ঞানচর্চাকে ঘিরেই।
আজ সেই মানুষটি নেই। তবে নলছিটির নীরবতায়, চোখের জলে আর প্রতিবাদের উচ্চারণে স্পষ্ট, শরিফ ওসমান হাদি শুধু একটি নাম নন; অনেকের কাছে তিনি একটি বিশ্বাস, একটি লড়াইয়ের প্রতীক।
আইকে/এসএন