জনদুর্ভোগের রাজনীতি: বৃত্ত ভাঙার দায় কার?

দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতার প্রত্যাবর্তন ঘিরে সমর্থকদের মধ্যে আবেগ, উচ্ছ্বাস এবং ব্যাপক প্রস্তুতির জোয়ার বইবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সমান্তরালে যখন জনজীবনের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়, তখন সেই পুরোনো প্রশ্নটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে : আমাদের রাজনীতি কি তবে এখনো নাগরিক অধিকারের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনকেই বড় করে দেখছে?

রাজধানীর খিলক্ষেতের ৩০০ ফিট সড়কের ওপর বিশাল মঞ্চ তৈরি করে জনসভার যে আয়োজন চলছে, তা সচেতন নাগরিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ৩০০ ফিট কেবল একটি রাস্তা নয়, এটি উত্তরার সাথে পূর্বাচল ও বৃহত্তর সিলেটের সংযোগকারী এক মহাধমনী। এর আশেপাশে রয়েছে এভারকেয়ারের মতো আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং অসংখ্য আবাসিক এলাকা। একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য যখন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবরুদ্ধতার কবলে পড়ে, তখন তা কেবল যানজট তৈরি করে না, বরং দেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির করে দেয়।

 প্রশ্ন জাগে, এই শক্তি প্রদর্শনের কি কোনো বিকল্প ছিল না? ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি, বসুন্ধরা (আইসিসিবি), কোনো খোলা মাঠ বা স্টেডিয়ামে কি এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যেত না?

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রাস্তা দখল করে আধিপত্য প্রমাণের সংস্কৃতি অত্যন্ত পুরোনো এবং দুর্ভাগ্যজনক। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখে আসছি, ক্ষমতায় থাকা দল হোক কিংবা রাজপথের বিরোধী দল— সবাই সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে রাজনৈতিক সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে যখন একজন মুমূর্ষু রোগী অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ হারান, যখন একজন পরীক্ষার্থী সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না, কিংবা একজন শ্রমজীবী মানুষ তার দিনের রোজগার হারান— তখন সেই রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি অন্যায্য? 


জনকল্যাণের দোহাই দিয়ে যে রাজনীতি আবর্তিত হয়, সেই রাজনীতিই যখন জনগণের দৈনন্দিন জীবনকে বিষিয়ে তোলে, তখন তাকে আর ‘জনগণের রাজনীতি’ বলা কঠিন হয়ে পড়ে।

এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে নাগরিক জীবন ও রাজনীতির মধ্যে একটি সুশৃঙ্খল সীমারেখা টানা হয়েছে। দিল্লির রামলীলা ময়দান বা কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের মতো নির্দিষ্ট স্থানগুলো বড় বড় সমাবেশের জন্য নির্ধারিত। ভারতের উচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশন কঠোরভাবে নিশ্চিত করেছে যে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বা জরুরি সেবার পথ বন্ধ করা যাবে না। সেখানেও ভিভিআইপি মুভমেন্ট হয়, বিশাল সমাবেশ হয়, কিন্তু তা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরাকে পুরোপুরি অচল করে দেয় না। 

অথচ আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও একটা নির্দিষ্ট সমাবেশস্থল বা শৃঙ্খলাবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব বোধ করছি।

আগামী ২৫ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে যে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হচ্ছে এবং ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে বিমানবন্দরে সাধারণ মানুষের প্রবেশে যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তা নিরাপত্তার খাতিরে যৌক্তিক মনে হলেও কার্যত এক ধরনের ‘অস্বাভাবিকতা’ তৈরি করছে। একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যদি রাষ্ট্রকে এতটা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে হয়, তবে তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিপক্বতা নয়, বরং প্রশাসনিক ও কাঠামোগত দুর্বলতাকেই প্রকট করে তোলে। 

ভিভিআইপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রতিশ্রুতি আমরা প্রায়শই শুনি, তার বাস্তব প্রতিফলন কই?

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব আমাদের এক ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই নতুন বাংলাদেশের ম্যান্ডেট ছিল বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। মানুষ রাজপথে রক্ত দিয়েছিল একটি মানবিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার আশায়। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী সময়েও যদি সেই একই ‘রাস্তা দখল’ আর ‘জনদুর্ভোগের’ রাজনীতি ফিরে আসে, তবে সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হবে। 

নতুন বাংলাদেশের রাজনীতি হওয়া উচিত পরিকল্পনামাফিক, যেখানে মিছিল হবে কিন্তু ফুটপাত ছাড়িয়ে নয়, জনসভা হবে কিন্তু জনজীবন থামিয়ে নয়।


দেশপ্রেম কেবল স্লোগানে বা ব্যানার-ফেস্টুনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না। প্রকৃত দেশপ্রেম হলো সাধারণ মানুষের কষ্টের প্রতি সহমর্মী হওয়া। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, বিশাল জনসমাগম দিয়ে সাময়িক প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হলেও জনগণের দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করতে হলে তাদের কষ্টের ভাগীদার হতে হয়। ৩০০ ফিট বা বিমানবন্দরের রাস্তা বন্ধ করে যে বিভীষিকা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা কোনোভাবেই জনবান্ধব রাজনীতির উদাহরণ হতে পারে না।

পরিশেষে বলতে চাই, জনদুর্ভোগের এই বিষাক্ত বৃত্ত থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি নাগরিক অধিকারের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকে, তবে তারা স্বউদ্যোগে জনাকীর্ণ রাস্তা পরিহার করে বিকল্প স্থানে কর্মসূচি পালন করবে। 

আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই যেখানে রাজনীতির পতাকা উড়বে নাগরিক স্বস্তির আকাশে, যেখানে মিছিলের স্লোগান মানুষের কান্নার শব্দকে ঢেকে দেবে না। রাজনৈতিক অধিকার অবশ্যই থাকবে, কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের পথ চলার অধিকারকে কেড়ে না নেয়।

সময় এসেছে পুরোনো ও জীর্ণ রাজনৈতিক আচরণকে কবর দিয়ে এক আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও জনহিতকর রাজনীতির চর্চা শুরু করার।


Share this news on:

সর্বশেষ

img
নায়ক রিয়াজের মৃত্যুর গুঞ্জন, মেলেনি সুনির্দিষ্ট তথ্য Dec 24, 2025
img
সম্ভাব্য জনদুর্ভোগের জন্য বিএনপির আগাম দুঃখ প্রকাশ Dec 24, 2025
img
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিয়েছেন রুমিন ফারহানা Dec 24, 2025
img
বগুড়ায় বিএনপি কার্যালয়ে হামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার Dec 24, 2025
img
দীপু চন্দ্র ও ওসমান হাদি হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হবে: প্রেস সচিব Dec 24, 2025
img
ঋণখেলাপির তালিকায় নাম থাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না মান্না Dec 24, 2025
img
সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ: বিবিএস Dec 24, 2025
img
রিকশায় করে এসে মনোনয়ন কিনলেন আমির হামজা Dec 24, 2025
img
বড় প্রজেক্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন অক্ষয় খান্না Dec 24, 2025
img
১১ কোটি টাকার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিলেন টেইলর সুইফট Dec 24, 2025
img
সিলেট বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ভিড় না করার নির্দেশ বিএনপির Dec 24, 2025
img
অস্কারে যাওয়ার আগেই ধাক্কার কবলে ‘হোমবাউন্ড’ Dec 24, 2025
img
ডেইলি স্টারে হামলায় লুট হওয়া কম্পিউটারসহ যুবক গ্রেপ্তার Dec 24, 2025
img
নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফিরছেন সামান্থা! Dec 24, 2025
img
বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলেন নুর-রাশেদ, কোন আসনে কে? Dec 24, 2025
img
ঢাকায় বড়দিন উপলক্ষ্যে আতশবাজি ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ Dec 24, 2025
img
ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা আগামীকাল : দুদু Dec 24, 2025
img
টেলিকমিউনিকেশন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে : প্রেস সচিব Dec 24, 2025
img
দীপিকার সেই বিতর্কে মতামত জানালেন কিয়ারা Dec 24, 2025
img
নুরের দল থেকে নির্বাচন অংশ নিচ্ছেন মেঘনা আলম Dec 24, 2025