মধ্যবিত্ত

দিনশেষে অভিনয়ের মিথ্যে হাসিগুলো রাতের আঁধারে বড্ড কষ্ট দেয়। রাত গভীর হয়ে আসলেই সব কষ্টগুলো নীরবে আঘাত হানে। ধুকে ধুকে খায় আমার মতো হাজারো নিম্নমধ্যবিত্তকে!

ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমি। সন্ধ্যার সূর্যটা বহু আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। রাস্তার হলুদ সোডিয়াম বাতিগুলোও জ্বলে উঠেছে আলোকময় নগরীকে আরেকটু আলোকিত করে দিতে। এই সময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে মানুষের, ফিরে যাওয়ার নীরব প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়ে যায়। ভিড় বাড়ে বাসে, এই যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, শ্যামলী, ডাক হাঁকায় কনট্রাক্টররা। আর যাত্রীদের ফিরে যাবার আকুলতা দেখতে থাকি আমি।

মানুষের জীবনটা বড় বিচিত্র। দিন শেষে রাতে পরিবারের পিছুটান এড়াতে পারেনা মানুষ। অবাক লাগে মাঝে মাঝে এরকম পিছুটান। আমার পাশেও ভিড় বাড়ে, অস্থায়ী বাসিন্দারা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীড়ে। শুধু আমিই ব্যস্ততার পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

হাতের জ্বলন্ত বেনসন এন্ড হেজেসটাও আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আমাদের পৃথিবীটাও হয়ত কোন জ্বলন্ত সিগারেট, প্রতি মুহূর্তেই ছোট হয়ে আসছে। আমার মত নিম্নমধ্যবিত্ত বেকারের হাতে এ জিনিস বেমানান। তবুও আজকের দিনে একটু বিলাসিতা হতেই পারে।

‘আমি’ এখানে আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র, গল্পের নায়ক সুহাস। এভাবেই কেটে যায় তার প্রতিটি রাত। আবার, খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের শিশির ভেজা মাঠে পা ডুবিয়ে শীতল হওয়াকে আত্মসাৎ করা, নিস্তব্ধ প্রস্তরখণ্ডের আড়ালে বসে নদীর কলতানকে আত্মস্থ করা, আর নীরবে নিভৃতে পাখিদের কলরব অনুভব করার মাঝেই কেটে যায় সুহাসের রাঙা সকাল।

অতঃপর দিনের বাকিটা সময় কেটে যায় নানা আয়োজনে। ক্লাসের পর টিউশনিতে যেতে হয়। মধ্যবিত্তের সংসার; বাবা অবসর নিয়েছেন অনেক দিন আগে। সামান্য টাকায় সংসার প্রায় অচল।

তবুও থমকে নেই সুহাস। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছুটে চলেছে পরিবারের দু-মুঠো সুখের খোঁজে। সুহাস বাসাই’তে সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনাও প্রায় শেষের দিকে- একটা সেমিস্টার বাকি আছে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের চাওয়া পাওয়াকে পূর্ণতা দিতে ছুটে চলেছে সুহাস। বাবা-মায়ের স্বপ্নের প্রতিটি মুকুল ছুঁতে আপ্রাণ চেষ্টা তার।

বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য আজ সে স্মৃতির শহর ছেড়ে বহুদূর গিয়ে পড়াশোনা করছে। বাড়িতে আছে অসুস্থ বাবা, মা ও আদরের ছোট বোন। সুহাস পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট্ট একটা চাকরি করে। টিউশনি করে নিজে পড়াশোনার খরচ চালায়, আর চাকরির টাকা বাড়িতে পাঠায়। কিন্তু ওই কয়টা টাকায় কিভাবে চলে তার পরিবার? তবুও সে থেমে নেই।

ছোট বোন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে, ফরম ফিলাপের জন্য টাকা লাগবে। কিন্তু সাহস করে ভাইকে বলতে পারছে না, অন্যদিকে তার বাবাও অনেক অসুস্থ।

এমন সময় সুহাসের ফোন বেজে উঠল-

- হ্যালো মা! তুমি কেমন আছো?

- আলহামদুলিল্লাহ বাবা আমি ভালো আছি।

- তুই কেমন আছিস?

- তোমরা ভালো আছো জেনেই আমি ভালো আছি।

- বাবা, তোকে একটা কথা বলতাম!

- জ্বী মা বলো। বাবা শান্তার পরীক্ষার ফরম ফিলাপের তারিখ এসে গেছে। কালকের ভিতরে ফরম ফিলাপ না করলে শান্তাকে আর পরীক্ষা দিতে দিবে না।

- আচ্ছা ঠিক আছে মা। শান্তাকে চিন্তা করতে না করো, আমি কাল সকালের ভিতরেই টাকা পাঠিয়ে দিবো।

- তোর অনেক কষ্ট হইতে আছে বাবা। আমি আর সইতে পারি না বাবা। এর থেকে আমার মরণ হলে ভালো হতো।

- এইসব তুমি কি আবোল-তাবোল বলতে আছো মা। একদিন ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। নতুন ভোর আসবে আমাদের জীবনে। বাবা কেমন আছে মা?

- তোর বাবা আর কি-রকম থাকবে! যখন ঔষধ খায় তখন ভালো। তবে বুকের ব্যথাটা একটু বাড়ছে।

- তুমি টেনশন কইরো না মা। আমি আগামী মাসে বেতন পেয়ে বাড়ি আসতে আছি। তখন বাবাকে ঢাকা নিয়ে এসে ভালো ডাক্তার দেখাবো।

ফোনটা রেখে দেয় সুহাস। দু’চোখ দিয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। কি করবে সুহাস?

সুহাসের মালিক খুব ভালো একজন মানুষ। সে সুহাসের পারিবারিক অবস্থার বিষয়ে সব জানে। কিছু টাকা দিয়ে সুহাসকে দেশের বাড়ি পাঠায়। সুহাসের দেশের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। সুহাস নদীপথে বাড়ি চলে যায়।

- বাবা তুমি আমার সাথে ঢাকা চলো। ঢাকা গিয়ে তোমাকে বড় ডাক্তার দেখাবো। তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।

- নারে বাবা। আমি ঠিক আছি, আমার ঢাকা যেতে হবে না। তুমি আসছো এতেই আমি ভালো হয়ে গেছি।

কিছুতেই সুহাসের বাবা ঢাকা গেলো না। সে তো জানে তার ছেলের পকেটে টাকা নেই। কি দিয়ে সে বড় ডাক্তার দেখাবে।

সুহাস ফিরে গেল কর্মস্থলে। গিয়ে মালিকের কাছে আরেকটা পার্টটাইম জবের কথা বলতে মালিক তার বেতন কিছু বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতে কি হবে?

কিছুদিন পরে বাড়ি থেকে নাইমের ফোন আসে। নাইম সুহাসের চাচাতো ভাই।

- সুহাস কই তুই?

- আমি তো ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম মাত্র। কাজে যাবো এখন।

- ভারাক্রান্ত কণ্ঠে নাইম বলো উঠলো - সুহাস তুই তাড়াতাড়ি আয় চাচা স্ট্রোক করেছে। আমরা তাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাইতে আছি। তুই তাড়াতাড়ি আয় চাচি অনেক কান্না করতে আছে।

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে সুহাস। ডাক্তারের সাথে কথা বলে, তার  বাবার ফুসফুসে ক্ষত ধরা পড়েছে। অতিদ্রুত একটা অপারেশন করতে হবে, বেশ খরচার ব্যাপার। আপনি টাকা যোগাড় করুন, আমরা অপারেশনের ব্যবস্থা করি।

এত টাকা কোথায় পাবে সুহাস?

সিনথিয়ার কাছে হাত পাততেও নারাজ হলো না। সিনথিয়া সুহাসের ভালোবাসার মানুষ। মনে মনে সে চিন্তা করে মেয়েটার কাছ থেকে হাত পেতে অনেক টাকা এনেছি। এখন টাকা চাইতে নিজেরও লজ্জা করে। আর যাই হোক, সিনথি নিশ্চয়ই আমাকে বুঝতে পারবে; এই বিপদের সময় ও একটা না একটা ব্যবস্থা করবেই।

সুহাসকে হতাশ করলো না সিনথি। টাকার যোগাড় হলো, কিন্তু সুহাস পারবে কি তার বাবাকে বাঁচাতে?

অপারেশন থিয়েটার রুম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলল - দুঃখিত আপনার বাবাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। কথাটা শুনে সুহাস আর সুহাসের মাঝে নেই। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সুহাস। আর বলতে থাকল বাবা আমি হেরে গেলাম। দরিদ্রতার কাছে আমি হেরে গেলাম। পারিনি তোমাকে বাঁচাতে বাবা। আমায় ক্ষমা করে দিও তুমি। সুহাসের মা এসে বলে বাবা তুই হারিস নি। তুই ভেঙ্গে পরিস না বাবা।  না, মা আমি ঠিক আছি।

তারপর বেশ কিছু দিন কেটে যায়।

একদিন হঠাৎ সুহাস জানতে পারে সিনথিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।

এখন কি করবে সুহাস?

সবই কি নিয়তির খেলা!

রাতের অন্ধকারে সুহাস একা একা হাঁটছে আর ভাবছে -

দরিদ্রতা বড্ড সাদাকালো করে দেয় জীবনটাকে। মধ্যবিত্তের ছকের ভেতর থেকে বেরুতে পারিনি আমিও। তাইতো বাবাকে বাঁচাতে পারিনি আমি, ভালোবাসার সিনথিকেও বিয়ে করতে পারলাম না। সবই কি আমার ভাগ্যের দোষ! নাকি দরিদ্রতা? নাকি আমি নিম্নমধ্যবিত্ত সেজন্য? নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে।

মা চাকরির কথা তুললে নীরবই ছিলাম আমি। ছকের জীবনটায় বাধা পরে গেছি আমরা, এই জীবনটাতেই সুখ খুঁজে নিতে চাই। আমি যে খুব অসুখী তা না, সুখেই আছি আমি। চারপাশের প্রাপ্তির খাতার দশমিক অংশটাও সুখ দিয়ে যায় আমাকে। অতৃপ্তির সুখ বিস্মিত করে, অবাক হয়ে ভাবি সুখটা আমাদের মাঝেই কত সহজে লুকিয়ে থাকে। শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা চোখে পড়েনা, আমরা ফেলতেই চাইনা। আমরা তুলনায় আটকে থাকি, সুখের তুলনাটা খুব সহজেই করে ফেলি, কিন্তু দুঃখটা? কষ্ট পাওয়ার শত কারণের মাঝে সেই কষ্টে হাসার কারণ থাকে সহস্রাধিক। ভীষণ সুখী মানুষ আমি, সুখ আমাকে একটু বেশীই ভালবাসে, তাইতো আলিঙ্গন করে নেয় আমাকে। কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয় বাবাকে, ভালোবাসার মানুষটিকে- এত সুখ আমি কিভাবে রাখবো?

মৃদু হাসি আমি। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, তার সকল আলো দিয়ে আধারে রেখে যাচ্ছে আমাদের, আমাকে। আচ্ছা, রাতটা কেন আসে? সুখের খাতার সাদা পাতা দেখতে, নাকি আদিমতার নেশাটা লুকিয়ে দিতে?

হয়তো কোন চাঁপা আর্তনাদকেই পথ খুঁজে দিয়ে যায় লাল সূর্য। রাতটা বড় নিঃসঙ্গ কাটে আমার। একমাত্র রাতেই আমার আমিটার সাথে পরিচিত হই আমি। আজ রাতটা শুধু আমার জন্যে। চাপা আর্তনাদকে বালিশ চাপা দিয়েই ঘুমোতে যাব আমি। হয়তো ঘুমাতে পারব, অথবা বালিশে কোন বর্ষার দমকা নামবে।

আসলে আমরা অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করি। এই অনিশ্চয়তার জন্যেই হয়ত প্রাপ্তির সুখটা এত দামী। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলেই আজ দরিদ্রতার কাছে আমি হেরে গেলাম। অতি সাধারণ সাদামাটা আমি যে এই অনিশ্চয়তার সম্ভাব্যতার ভগ্নাংশে বেঁচে থাকি।

কি করবো আমি? কি করার আছে আমার!

আমি যে নিম্নমধ্যবিত্ত!

হ্যাঁ আমি নিম্নমধ্যবিত্ত।

এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।

 

(গল্পটি ‘মধ্যবিত্ত’ নাটক এবং কিছু বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত)

লেখক: শিক্ষার্থী, সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউট

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
একাত্তরের ন্যায় চব্বিশকেও সম্মান-শ্রদ্ধা করার আহ্বান জামায়াত আমিরের Dec 15, 2025
img
ভোটে দায়িত্বরত সবার তথ্য নিচ্ছে ইসি Dec 15, 2025
img
গায়ে হলুদে মুগ্ধতা ছড়াল কেয়া পায়েল Dec 15, 2025
img
টি-টোয়েন্টিতে চেনা ছন্দে নেই গিল Dec 15, 2025
img
মধ্যরাতে স্ত্রীকে বাদ দিয়ে অন্য কোন নারীর সঙ্গে জয়! Dec 15, 2025
img
জাহান্নাম থেকে হলেও হামলাকারীকে আনতে হবে : জুমা Dec 15, 2025
img
১৬ বছর রাতে ঘুমাননি মির্জা ফখরুল: রাহাত আরা বেগম Dec 15, 2025
img
সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে হাদিকে Dec 15, 2025
img
কনার ‘মেহেন্দি’ গানে নাচলেন বলিউডের নোরা ফাতেহি Dec 15, 2025
img
বাংলাদেশে মার্কিন নাগরিকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি Dec 15, 2025
ন্যাটোতে যোগদানের আশা ত্যাগ করলো ইউক্রেন Dec 15, 2025
স্বৈরশাসনের অন্যায় সংস্কৃতি ভাঙার আহ্বান তারেক রহমানের Dec 15, 2025
উপ-উপাচার্যের মন্তব্য ঘিরে প্রশাসনিক ভবনে তালা- যা বললেন চবি ছাত্রদল নেতা Dec 15, 2025
উপ-উপাচার্যের মন্তব্য ঘিরে প্রশাসনিক ভবনে তালা- যা বললেন চবি ছাত্রদল নেতা Dec 15, 2025
দফায় দফায় দুটি ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে গেলেন সাদিক কায়েমরা! Dec 15, 2025
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে যা বললেন মঞ্জু Dec 15, 2025
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে যা বললেন মঞ্জু Dec 15, 2025
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে যা বললেন মঞ্জু Dec 15, 2025
img
কমেন্ট বক্স না থাকলে অনেক সংসার বেঁচে যাবে : দর্শনা Dec 15, 2025
img
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সিইসি দায়িত্বে থাকতে পারেন না : নাহিদ ইসলাম Dec 15, 2025