১১ গ্রুপের আড়াই লাখ কোটি টাকা খেলাপি

আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে ঋণের নামে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আদায় হচ্ছে না বলে এই অর্থ এখন খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। ওই সময় সরকারের নীতিনির্ধারক ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটলেও ‘নীরব দর্শক’র ভূমিকায় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক।

শুধু তাই নয়, আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করেই লুটপাটকারীদের সহায়তা করে নিজেরা (কেন্দ্রীয় এবং সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা) লাভবান হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি আজ ‘খাদের কিনারায়’। ব্যাংকের তারল্য প্রায় শূন্যের কোঠায়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই খাতে লুটপাটের ব্যাপক তদন্ত শুরু করে। যা এখনো চলমান। এ পর্যন্ত ১১টি বড় শিল্প গ্রুপের নামে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে যে লুটপাট করা হয়েছে তার মধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে পাচার হওয়া কিছু ঋণ আদায় অযোগ্য ঋণে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) এখন পর্যন্ত তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি করা অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এই প্রতিবেদন আরও বিশদ তদন্তের জন্য সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আরও ব্যাপক তদন্ত করছে।


প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে মোট খেলাপি ঋণের ৭২ শতাংশই আটকে আছে ওই ১১ গ্রুপের কাছে। এছাড়া ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) খেলাপি ঋণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব গ্রুপের লুটপাট করা অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। যে কারণে এগুলো খেলাপি হচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ আগামীতে আরও বেড়ে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের।

এছাড়া সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার নিয়ে ১০টি বড় গ্রুপের বিষয়ে বিশদ তদন্ত করছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাইফুর আলম মাসুদের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের ভাই আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সিকদার গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে কয়েকটির ব্যাংক ঋণ উল্লিখিত খেলাপির তালিকায় রয়েছে। পাশাপাশি বিগত সরকারের সময়ে যারা জালিয়াতি করেছে তাদের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) এখন পর্যন্ত তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-তাদের নামে-বেনামে আরও ঋণ থাকতে পারে। ফলে মোট ঋণের স্থিতি আরও বেড়ে যাবে। আলোচ্য ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত মূলঋণ ও সুদসহ খেলাপি ঋণ হিসাবে ৫৩ হাজার কোটি টাকা শনাক্ত করা হয়েছে। গ্রুপটি বিভিন্ন সময়ে যে সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়েছে সে হিসাব এর বাইরে রয়েছে। সুদ মওকুফের হিসাব আমলে নিলে গ্রুপের খেলাপি ঋণ আরও বেশি হবে। তারা দেশের ১৬টি ব্যাংক ও ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ঋণ নিয়েছে। তবে তাদের মাত্রাতিরিক্ত ঋণের কারণে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকের অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ টাকা ৫০ হাজার টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। কারণ ওইসব টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। ফলে ওইসব ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। যে কারণে সেগুলোকে খেলাপি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রুপটি এসব ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই নিয়েছে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৫ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা।

দেশে আরও একটি বড় শিল্প গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকায়। তাদের মোট ঋণের বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে। গ্রুপটির বিভিন্ন কোম্পানির নামে মোটা অঙ্কের ঋণ রয়েছে। ঋণের বড় একটি অংশ তারা বিদেশে পাচার করে বিভিন্ন কোম্পানি গঠন করেছেন। কিন্তু ওইসব অর্থ তারা দেশে আনছেন না।

সিকদার গ্রুপের নামে-বেনামে ৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। আগে তাদের ঋণের প্রকৃত তথ্য ছিল ২ হাজার কোটি টাকার কম। বেনামি কোম্পানিগুলো শনাক্ত হওয়ায় তাদের ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে। যে কারণে তাদের খেলাপি ঋণের অঙ্কও বেড়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রুপের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি ডলার।

নাবিল গ্রুপের মোট সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এসব ঋণের বড় অংশেই জালিয়াতি হয়েছে। এর মধ্যে তদন্তে ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আলোচ্য ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

নাসা গ্রুপের মোট ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খেলাপি ১১ হাজার কোটি টাকা। ২৭টি ব্যাংক ও ১টি ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে এসব ঋণ নেওয়া হয়। তাদের ঋণের স্থিতি ও খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে। কারণ গ্রুপটি ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে বিভিন্ন কোম্পানি খুলেছে। এসব কোম্পানির আয়-ব্যয় দেশে আনা হচ্ছে না। ফলে ওইসব ঋণ পরিশোধ না করার কারণে এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধরীর পরিবার তাদের মালিকানাধীন ইউসিবি ব্যাংক থেকে আরামিট গ্রুপের নামে সরাসরি নিয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে গেছে। এছাড়াও নামে-বেনামে বিভিন্ন কাগুজে কোম্পানি খুলে এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে আরও ২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে সাইফুজ্জামান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণের মধ্যে ইতোমধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। বাকি ঋণও খেলাপির পথে এগোচ্ছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ কেলেংকারির মাধ্যমে এননটেক্স গ্রুপ ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের প্রায় শতভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে। সুদসহ খেলাপির অঙ্ক আরও বেশি। ঋণ কেলেংকারির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট লেদার নিয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। যার প্রায় পুরোটাই খেলাপির হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। তবে বড় অংশই এখন খেলাপি।

সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যার প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি। বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার। এসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। রতনপুর গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে নিয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এসএম/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গণতন্ত্রকে আর রক্তাক্ত না করি : নাজমুল হক প্রধান Aug 24, 2025
img
সাঈদীর বিরুদ্ধে হাসিনা মিথ্যা সাক্ষী বানিয়েছিল : রিজভী Aug 24, 2025
img
উপদেষ্টা আসিফের সঙ্গে নারীর ভাইরাল ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি Aug 24, 2025
img
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিঃসন্দেহে একটি নিরপেক্ষ সরকার : রিজভী Aug 24, 2025
img
৩ সেঞ্চুরি ও ২ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৪৩১ Aug 24, 2025
img
নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে চালু হওয়ার তিন মাসে ৩ রোহিঙ্গা আটক Aug 24, 2025
ভাইরাল অডিওর অভিযোগ পেরিয়ে এনসিপিতে ফিরলেন সারোয়ার তুষার Aug 24, 2025
img
বিএনপির নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন তারেক রহমান : এ্যানি Aug 24, 2025
img
রাজনীতি করতে গেলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় : এ্যানি Aug 24, 2025
দেশের পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন জি এম কাদের Aug 24, 2025
পরিবারসহ দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে ওমান Aug 24, 2025
শেখ হাসিনা ভারতের লোক: সালাহউদ্দিন আহমদ Aug 24, 2025
img
মাদকমুক্ত নেতৃত্ব নিশ্চিতে ডাকসু প্রার্থীদের ডোপ টেস্টের দাবি Aug 24, 2025
রাশমিকা ও আয়ুষ্মানের নতুন কেমিস্ট্রি ভূতুড়ে প্রেমকাহিনী ‘থাম Aug 24, 2025
"৩০ বছরের প্রেমে ফাটল! কী ঘটছে গোবিন্দার জীবনে?" Aug 24, 2025
দেবের নতুন ছবির ব্যস্ততা, হঠাৎ অসুস্থ রুক্মিণী! Aug 24, 2025
img
জুলাই সনদে মতামত দিল আরও ৩ দল Aug 24, 2025
রোনালদো-বিপাশার সম্পর্ক নিয়ে ভক্তদের উত্তেজনা! Aug 24, 2025
img
‘ট্রাম্পের বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচত’, ভারতকে সতর্ক করে নিকি হ্যালির পোস্ট Aug 24, 2025
মনের দুইটা অনুভূতি Aug 24, 2025