শেয়ার বাজারে এক দশকে বিনিয়োগকারী কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে

কারসাজি ও অনিয়মের বৃত্ত ভেঙে যেন দাঁড়াতে পারছে না শেয়ার বাজার। মুনাফার আশায় এসে উলটো পুঁজি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে গত এক দশকে বিনিয়োগকারী কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। বিনিয়োগে সক্ষম মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ না করে সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনে বা ব্যাংকে আমানত রেখে যতটা 'রিটার্ন' পাচ্ছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকছেন এই ভেবে যে, অন্তত পুঁজি হারাচ্ছেন না।

প্রায় দুই যুগ আগে ইলেকট্রনিক শেয়ার ধারণের ব্যবস্থার জন্য সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ৭৯ লাখ ৫১ হাজার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এর মধ্যে এখন সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট ১৬ লাখ ৮৭ হাজার। নিজ নামে পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকার পরও যৌথ অ্যাকাউন্ট আছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার। অর্থ্যাৎ ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট ১২ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে অনেকের বহু সংখ্যক অ্যাকাউন্ট আছে। বাস্তবে সক্রিয় বিনিয়োগকারী ৫ লাখের বেশি নয় এমনটি জানান শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্টরা। ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ রয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ১ শতাংশও নয় (মাত্র শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ)।

এই যখন বাংলাদেশের চিত্র, তখন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ প্রতিবেশী ভারতের বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট ১১ কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কার সোয়া ২ কোটি মানুষের বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট ৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশের বেশি। খাইল্যান্ডে এ হার প্রায় ২৩ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৫৩ শতাংশ। মজার বিষয় হলো মাত্র ৫৬ লাখ মানুষের দেশ সিংগাপুরের প্রতি দুই জনে একজনের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ রয়েছে।

শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজি সংগ্রহের অন্যতম প্রধান হিসেবে পুঁজিবাজারকে প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন দেশের সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সিংগাপুর, চীনের মতো দেশের কথা তো বলাই বাহুল্য। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার মতো দেশেও সরকারের নীতি-প্রণোদনা ও বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির কারণে প্রতিবছর বহু কোম্পানি শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে। ভালো মুনাফা পাওয়ায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে এসব দেশে।

ডিবিএ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আক্ষেপ করে বলেন, বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের কথা উঠলেই-বাজার তলানিতে, কারসাজি, দরপতন, আস্থাহীনতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাব ইত্যাদির মতো নেতিবাচক শব্দ ছাড়া ভালো কিছু শোনা যায় না। ঐ আলোচনাসভায় দেশের অন্যতম প্রধান ব্রোকারেজ হাউজ আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুদ্দিন বলেন, গত ১৬ বছরে শেয়ার বাজার প্রায় ৩৭ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।

সংকুচিত হওয়ার কারণ স্পষ্ট। ছিয়ানব্বইয়ের বাজার ধসের পর কারসাজি প্রতিরোধে শেয়ার সার্টিফিকেটের বদলে ইলেকট্রনিক শেয়ার কেনাবেচা এবং লেনদেনেও অটোমেশন চালু হয়। তবুও কারসাজি বন্ধ হয়নি। পুরোনো কারসাজির কোনো বিচারও হয়নি। ফলে ২০০৯ ও ২০১০ সালে ফের কারসাজি হয়। ফলে ঐ বছরের শেষে যে ধস নামে তাতেও লাখ লাখ মানুষ পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। হতাশায় আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে বদলের পর তারা স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় মালিকদের বদলে স্বতন্ত্র পরিচালকদের নেতৃত্বে পরিচালন ব্যবস্থা ডিমিউচুয়ালাইজেশন প্রবর্তন করে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নীতিমালা করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতেও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হয়েছে। বাস্তবে এ ব্যবস্থা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং কারসাজি প্রতিরোধে কোনো ভূমিকাই রাখেনি।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতের মন্দ অভিজ্ঞতা এ অবস্থার জন্য দায়ী। অতীতে এ বাজারে সুশাসন বলে কিছু ছিল না। ফলে বিনিয়োগের বিপরীতে ভালো 'রিটান' বা মুনাফা পাননি বিনিয়োগকারীরা। কারসাজি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ছিল না, বিচারও হয়নি। যে কারণে মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে আস্থা হারিয়েছে।

শেয়ার বাজারে কারসাজি শুধু বাংলাদেশে হয় এমনটা নয়। তবে কারসাজি নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করার জন্য কম-বেশি দৃশ্যমান তৎপরতা ও কঠোর বিচারের কথা অন্যান্য দেশে দেখা যায়, যা এ দেশে দেখা যায় না। ভারত বা মালয়েশিয়ায় বাজারে কিছু ধস এলেও তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করে। শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও সিংগাপুরের বাজারেও সুশৃঙ্খল কাঠামো থাকায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেশি।

যেসব দেশের শেয়ার বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেশি, সেখানে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বেশি দেখা যায়। আবার বাংলাদেশের বেশির ভাগ তালিকাভুক্ত কোম্পানি আকর্ষণীয় লভ্যাংশ প্রদান করে না। কিছু কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ দেয় না বা নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অসঙ্গতি ও স্বচ্ছতার অভাব বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দেশে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই বিনিয়োগের মৌলিক নীতি বোঝেন না এবং শুধু গুজবে ভিত্তি করে বিনিয়োগ করেন। বাজারের কিছু অসাধু ব্যক্তি ও গ্রুপ এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে।

বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন। বাজার কারসাজির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় সাধারণ মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে অনীহা বেড়েছে।

এফপি/এসএন


Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় নন, আইপিএলে সিংহের মতো খেলতে চান কোহলি Aug 23, 2025
img
প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে কোনো মেগাপ্রকল্প নেওয়া হবে না : রিজওয়ানা Aug 23, 2025
img
চঞ্চল নন, ‘সোলজার’-এ শাকিবের মুখোমুখি হবেন মাহফুজ! Aug 23, 2025
img
আমরা কোথাও গেলে মানুষ ধানের শীষ বলে স্লোগান দেয় : মাহমুদ টুকু Aug 23, 2025
img
রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উপনির্বাহী পরিচালক Aug 23, 2025
img
শিবির জিতলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র পালটে যাবে : এম এ আজিজ Aug 23, 2025
স্বপ্নে নয়, ঘুমিয়েই এবার ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা চালাবেন এক প্রার্থী Aug 23, 2025
একসময় যেটি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, আজ তা দাঁড়িয়ে আছে অবহেলায়! Aug 23, 2025
img
স্বাধীনতার পর এবারই রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য মজুদ : মহাপরিচালক Aug 23, 2025
img
ভোটকেন্দ্রে সাড়ে ৬ লাখ আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে: আনসার মহাপরিচালক Aug 23, 2025
img
এশিয়া কাপকে সামনে রেখে ভারতীয় অ্যানালিস্টকে নিয়োগ দিলো বিসিবি Aug 23, 2025
img
বাংলাদেশি ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি Aug 23, 2025
img
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যে সকল আলোচনা হলো জামায়াতের Aug 23, 2025
img
বউ রেখে আরেক নারীর দিকে চোখ যায় কেমনে : কনস্টেবলকে বিচারক Aug 23, 2025
img
প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে কটাক্ষের মুখে মৌনীর কড়া জবাব Aug 23, 2025
img
হাওর-চরাঞ্চলে শিক্ষকদের থাকতে না চাওয়াটা সামাজিক সমস্যা Aug 23, 2025
নতুন মৌসুমে ন্যু ক্যাম্পে ফেরার আশা বার্সার! Aug 23, 2025
আসন্ন নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার Aug 23, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর সব শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা কানাডার Aug 23, 2025
img
ময়মনসিংহে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ১৯ আসামি কারাগারে Aug 23, 2025