‘আগামীতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে সব দল ও পেশাজীবীকে নিয়ে যেন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। যা নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক হিসেবে কাজ করবে।’, বলেছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ।
রবিবার (২৫ মে) রাজধানীর তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘স্কুল অব লিডারশিপ’ বাংলাদেশ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারের তিনি এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশে সামাজিক দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং সুশাসন’ শীর্ষক সেমিনারে দেশের বিভিন্ন দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, গবেষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, উন্নয়ন কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হাসান হাফিজ বলেন, ‘আগামীতে আমাদের দেশে অনেকগুলো নির্বাচন হবে। আমাদের সামনে যে নির্বাচন সেখানে যেন স্থানীয়ভাবে সব জায়গায়, সব সামাজিক শক্তি ও পেশাজীবীকে নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। যেন নির্বাচনে স্বচ্ছতা থাকে, জবাবদিহি থাকে। একটা অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সব দলীয় মানুষদের নিয়ে যেন এটা আমরা করি।
যা একটি স্থায়ী কমিটির মতো হবে। যারা নির্বাচনে প্রশাসনকে সাহায্য করবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য পরিস্থিতি অ্যাড্রেস করতে পারে। এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করতে পারি।’
সেমিনারে আলোচ্য বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, যে প্রশ্নটি তোলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে আমরা ফলোয়ার তৈরি করছি, নাকি লিডারশিপ তৈরি করি। আমরা ফলোয়ার তৈরি করি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। আপনি যতই উন্নত মডেল দেন, ইউরোপ-আমেরিকার সাথে তুলনা করেন, এটা বাংলাদেশের সাথে মিলবে না। আমাদের কেমিস্ট্রিটা ভিন্ন হয়েছে।
এবারের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সর্বোপরি এত রক্তপাত হয়েছে, সেটা একটি নতুন ফেনোমেনন। বাংলাদেশে যত ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১ ও ৯০ সালের বলেন; এই ২৪ সালের আন্দোলনের ছাত্ররা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এটা নতুন একটা ফেনোমেনন। কিন্তু ক্ষমতা হচ্ছে এমনই চোরাবালি, সেখানে বিভ্রান্ত হওয়ার, মাথা ঠিক না রাখার বিষয় আসতে পারে। ওরা একটা রাজনৈতিক দল করেছে, সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বৈঠক নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি বলেন, ‘সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে সেভাবে অস্থায় নিচ্ছে না। যদি নিত তাহলে রাজনৈতিক এই সংকট তৈরি হতো না।
গতকালকে বৈঠক হয়েছে, আমরা তো অধীর আগ্রহে ছিলাম যে একটা সমাধান আসবে। কিন্তু আসেনি। আজ বা আগামীকাল হয়তো আসতে পারে। সেটাও আংশিক আসতে পারে। যাই হোক আমাদের ফেনোমেননটা, দৃষ্টিটা অন্য রকম। এটা ইউরোপ-আমেরিকার মডেলের সাথে মিলবে না। তবে আমাদের সোশ্যাল লিডারশিপও তৈরি হচ্ছে। সেটা কিন্তু একত্রিত না। যা একটা ছাতার মধ্যে আসতে হবে। এটা ক্রিস্টালাইজ হতে হবে। এতে হতাশার কোনো কারণ নাই।’
সীমান্তে রক্ত ঝরাকে অত্যন্ত বেদনাদায়ক উল্লেখ করে কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘এটা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিও বটে। কিন্তু আমরা সেভাবে, সেই অর্থে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারছি না। এখান আমাদের রুখে দাঁড়ানো উচিত, কিছুটা আমরা দাঁড়িয়েছি সেটাও ঠিক। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের আরো কঠোর হতে হবে, সচেতন হতে হবে। ভারতীয় স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি, ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো এ বিষয়ে ভালো সাড়া পাইনি। আমাদের দেশের বিভিন্ন চ্যানেল, পত্রিকার ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দেশের কোনো চ্যানেল সেখানে দেখানো হয় না। আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমরা মাথা বিক্রি করে দিইনি। আমরা ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব চাই। কাঁটাতারে কোনো ফেলানীর লাশ আর দেখতে চাই না। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। এগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্বদের বিবেচনায় নিতে হবে।’
সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে দাবি উঠেছে, আমার মনে হয় রাজনীতির মধ্যে সংস্কার করা উচিত, সেনাবাহিনীর মধ্যেও হওয়া উচিত। এই কথাগুলো সাহস করে বলতে হবে। সেনাবাহিনী আমাদের অংশ, আমাদের অহংকারের ইনস্টিটিউশন। কারণ গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদ সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে এই সরকার ক্ষমতা নিয়েছে, কাজ করছে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদে কারো কারো অপরিপক্বতা আছে, অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতা আছে। তারা বিতর্কিত হয়ে যাক এটাও চাই না। আমরা চাই ড. ইউনূসের সরকার যেন সম্মানের সহিত বিদায় নেয়। একটা সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মডেল যেন তারা উপহার দিয়ে দিতে পারেন। এতে আমাদের নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে। ২৫ জন উপদেষ্টার পক্ষে অনেক কিছু করে যাওয়া সম্ভব নয়। তাদের হাতে তো আলাদিনের চেরাগ নেই। সরকারকে আমি আবারো বলব, রাজনৈতিক দলগুলোকে অস্থায় নেন। সর্বদলীয় মতো ও জাতীয় সংকটটাকে বিবেচনায় নেন। আমাদের নেতৃত্বের দরকার আছে। হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তবে রাতারাতি আমরা যেন কোনো কিছু আশা না করি। বেশ কয়েকটা নির্বাচন যদি হয়, তাহলে থিতু একটা অবস্থা হবে। তখন আমরা কিন্তু একটা পারফেকশনের আশা করতে পারি। আমরা যেন সংযমের পরিচয় দিই। বিএনপি কিন্তু নিজেদের এখন আগের থেকে অনেক কিছুই চেঞ্জ করেছে। কঠোর অ্যাকশন নিচ্ছে। আরো অ্যাকশন দেখতে চাই, আরো মনিটরিং চাই। আওয়ামী লীগ ভালো ছিল, এই অপবাদটা যেন কেউ দিতে না পারে। এ কথাটা যেনো আমাদের শুনতে না হয়। সুতরাং মনে করি, বিএনপির দায়িত্বটা এখানে অনেক অনেক বেশি। রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, সুযোগ দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিন, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জজ, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. জামিল আহমেদ, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ চ্যাপাটারের প্রতিনিধি ফয়েজ কাওসার, সমন্বয়ক মেজর (অব.) সিদ্দিক, মেজর জেনারেল আশাব উদ্দিন (অব.), কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান, ইয়ুথ পার্লামেন্টের সভাপতি অ্যাড. আমিনুল ইসলাম মুনীর প্রমুখ।
আরএ/টিএ