ছবি পরিবর্তন করে এক যুগ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি,অবশেষে ধরা

বাংলাদেশ ব্যাংকে ছবি টেম্পারিং করে একজনের বদলে আরেকজনের চাকরি করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ধরা পড়েছে। দীর্ঘ এক যুগ ধরে প্রতারণা করে চাকরি করার পর তদন্তে সত্যতা মিললে সম্প্রতি সেই নিয়োগ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী নামে একজন ব্যক্তি ২০১৩ সালে সহকারী পরিচালক (প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা) পদে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেন। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি চাকরির জন্য কোনো পরীক্ষাই দেননি। মূল পরীক্ষার্থী ছিলেন তার আত্মীয়, আর পুরো বিষয়টি চাচার সহায়তায় ছবি টেম্পারিং ও জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়।

এরইমধ্যে দুটি পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন যুগ্ম-পরিচালক। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। একটি মামলায় পুলিশি তদন্তে ধরা পড়ার পর বুধবার (২৮ মে) তার নিয়োগ বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তার চাচা বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক শাহজাহান মিঞাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া সবার তথ্য পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী নামের এক ব্যক্তি আসলেই ২০১৩ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে চাকরি পান। একই সময়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হয় তার। আসল আনসারী বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান না করে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন।

তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী হিসেবে এতদিন যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে আসছেন তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ঠিকানা উল্লেখ আছে গাজীপুর। যদিও তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। জালিয়াতি করে এই জাতীয় পরিচয়পত্রও পরে বানিয়েছেন। তার প্রকৃত নাম মো. শাহজালাল বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবারও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসে আসেন। তবে দুপুরের দিকে নিয়োগ বাতিল করে অফিস আদেশ জারি হওয়ার পর আর দেখা যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ। যতদূর শুনেছেন তিনি বাসায়ও যাননি। তার চাচা শাহজাহান মিঞারও টেলিফোন বন্ধ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে প্রকৃত আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী বলেন, তার আপন বোন জামাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চাকরি করেন। কোনো একটি কাজে সম্প্রতি রাজশাহী অফিসে যান। সেখানে একই নামের নেমপ্লেট দেখে ছবি তুলে তার হোয়াটসঅ্যাপে দেন। তার এই ব্যতিক্রম নামের সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়ায় খুনশুটি করে বলেছিলেন– ‘এতদিন পৃথিবীতে মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী নামে একজন ছিল। এখন আরেকজনকে পাওয়া গেল।’

তিনি জানান, বুধবার পরিচিত কয়েকজন দুপুরের পর নকল আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর নিয়োগ বাতিলের খবর জানান।

জানা গেছে, কোনো একটি মামলার তদন্তের জন্য আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর বিষয়ে খোঁজখবর করছিল পুলিশ। তদন্তে গিয়ে বিভিন্ন অসংগতি উঠে আসে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া তথ্য এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত তথ্যে কোনো মিল নেই। সোমবার পুলিশ বাংলাদেশ ব্যাংকে এই তথ্য দেয়। প্রাথমিক যাচাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য পায় জালিয়াতির মাধ্যমে ছবি টেম্পারিং করে তাকে এই পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। যখন এই নিয়োগ হয়েছে, ওই সময় নিয়োগ শাখায় কর্মরত ছিলেন আপন চাচা শাহজাহান মিঞা। ফলে দেরি না করে আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। আর শাহজাহান মিঞাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিষয়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের দেওয়া তথ্যের সত্যতা পাওয়ায় তার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। কিছুদিন আগে ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া একজন নারী কর্মকর্তার বাবার ভুয়া সনদ প্রমাণিত হওয়ার তাকে অপসারণ করা হয়েছে। ওই ঘটনার সঙ্গেও শাহজাহান মিঞার নাম এসেছিল। এর আগে একজন নির্বাহী পরিচালক টেম্পারিং করে বয়স বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়লেও শেষ পর্যন্ত তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। তিনটি ঘটনার সময়ই গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ড. আতিউর রহমান।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সময়ে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যে কারণে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া প্রতিটি নিয়োগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এখনও এ বিষয়ে অফিস আদেশ হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এ কাজে সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত মো. শাহজাহান মিঞার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।


এমআর


Share this news on:

সর্বশেষ

img
টোকিওর সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা, পাবেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি May 30, 2025
img
৪ ঘণ্টা পর ফেরি চলাচল শুরু দৌলতদিয়া রুটে May 30, 2025
‘তোয়ালের দৃশ্য’ নিয়ে নাজেহাল অবস্থা হয় রণবীরের! May 30, 2025
img
স্বচ্ছ নির্বাচনই অগ্রাধিকার, দীর্ঘমেয়াদে থাকতে চান না বুলবুল May 30, 2025
img
ইসরায়েলে ৯০ হাজার টন যুদ্ধসরঞ্জাম পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র May 30, 2025
img
‘বর্ডার টু’তে সানি দেওলের সঙ্গে থাকছেন দিলজিৎ May 30, 2025
img
বাংলাদেশ থেকে ৭৬ হাজার ৩২৪ হজযাত্রী পৌঁছেছেন সৌদি আরবে May 30, 2025
চীনা গুপ্তচর ভয়ে ভারত, বিপাকে নজরদারি ক্যামেরা কোম্পানি May 30, 2025
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতের সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপোষ করবেন না সারজিস May 30, 2025
img
এখন আমারো বলতে ইচ্ছা করে— নাটক কম করো পিও: মাসুদ কামাল May 30, 2025
img
আজ থেকে খুলবে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান, বাজুস কর্মসূচি স্থগিত May 30, 2025
img
ইংল্যান্ডের ইতিহাসগড়া ইনিংস, সেঞ্চুরি ছাড়াই ৪০০ রান May 30, 2025
img
নিম্নচাপ স্থলভাগে, ৭ বিভাগে অতিভারি বর্ষণ ও পাহাড়ধসের শঙ্কা May 30, 2025
img
সকাল ৯টার মধ্যে ১৩ জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস May 30, 2025
img
নির্বাচন নিয়ে দিল্লির কোনো প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশে কাজ করবে না: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী May 30, 2025
img
ট্রাম্পের শুল্ক বহাল থাকছে, আদালতের স্থগিতাদেশ May 30, 2025
img
গাজায় ইসরায়েলি হামলা, নিহত আরও ৬৭ May 30, 2025
img
ডিএসইতে আরও ২১০৫ কোটি টাকার বড় ক্ষতি May 30, 2025
img
স্টেশনে জায়গা ভাড়া নেয়ার আবেদনের সময় বাড়ালো মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ May 30, 2025
অপু-বুবলীর ফেসবুক যুদ্ধ: শাকিব খানের প্রতিক্রিয়া কী? May 30, 2025