বিশ্বের প্রতি ছয়জন মানুষের একজন একাকীত্বের শিকার, আর এর কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারান লাখো মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর নতুন এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক তথ্য। গবেষণায় বলা হয়েছে, তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই একাকীত্বের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, আর এদের মধ্যে কিশোরী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি একাকীত্ব অনুভব করে।
ডব্লিউএইচওর 'কমিশন অন সোশ্যাল কানেকশন'-এর এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০.৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এবং ৩০ বছরের নিচে ১৭.৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জানিয়েছেন, তারা একাকীত্ব অনুভব করেন। ৬০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে এই হার ১১.৮ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ ও নারীরা একাকীত্বে মোটামুটি সমানভাবে আক্রান্ত হলেও ২৪.৩ শতাংশ কিশোরী নিজেদের সবচেয়ে একা বলে মনে করেন, যা বিশ্বব্যাপী সব শ্রেণির মধ্যে সর্বোচ্চ।
ড. বিবেক মার্থি, সাবেক মার্কিন সার্জন জেনারেল ও কমিশনের সহসভাপতি, এই সংকটের পেছনে উল্লেখ করেছেন বেশ কয়েকটি কারণ। তার ভাষায়, "দুর্বল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও অতিরিক্ত বা ক্ষতিকর ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার, যা তরুণদের মধ্যে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।"
ডব্লিউএইচও একাকীত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছে এমন এক 'বেদনাদায়ক অনুভূতি' হিসেবে, যখন একজন ব্যক্তি তার প্রত্যাশিত সামাজিক সম্পর্কগুলো পান না। অন্যদিকে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বোঝায় পর্যাপ্ত সামাজিক সংযোগ না থাকাকে। যদিও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে তথ্য তুলনামূলকভাবে কম, কমিশনের মতে, প্রতি তিনজন বয়স্কের একজন এবং প্রতি চারজন তরুণের একজন এতে আক্রান্ত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা একসঙ্গে প্রতি বছর আনুমানিক ৮ লাখ ৭১ হাজার মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস এবং মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।তবে শক্তিশালী সামাজিক সম্পর্ক একজন মানুষের স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে এবং আয়ুষ্কালও বাড়াতে সহায়ক হয় বলে জানিয়েছে কমিশন।
একাকীত্ব রোধে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জাতীয় সরকারগুলোকে একাকীত্বকে স্বাস্থ্যনীতি হিসেবে বিবেচনায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।ড. মার্থি বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে আমরা সামাজিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিইনি। এখন সেই অবস্থা বদলাতে হবে।"
ইতোমধ্যে কিছু দেশ একাকীত্ব মোকাবিলায় বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন, সুইডেন চলতি বছর একাকীত্ব মোকাবেলায় ৩০ মিলিয়ন ইউরোর একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর আওতায় বয়স্ক, একা থাকা মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সুইডেনের সমাজকল্যাণ ও জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী জ্যাকব ফোরস্সমেদ জানিয়েছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণদের জন্য "অ্যাক্টিভিটি কার্ড" চালু করা হবে। এই কার্ডে দেওয়া অর্থ খরচ করা যাবে শুধুমাত্র এমন কার্যক্রমে, যেখানে অন্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায়—যেমন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা আউটডোর এক্টিভিটি।
তার মতে, "এটি শুধু একাকী মানুষদের সমস্যা নয়। এটি পুরো সমাজের সমস্যা।"
বিশ্বজুড়ে একাকীত্ব এখন আর কেবল ব্যক্তিগত বেদনার নাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই একাকীত্ব যে গভীর ক্ষত তৈরি করছে, তার দায় সমাজকেই নিতে হবে। এখন সময়, সামাজিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সহমর্মী, সংযুক্ত সমাজ গড়ে তোলার। যাতে একাকীত্ব নয়, সম্পর্ক আর সম্মিলন হয় আগামী পৃথিবীর পরিচয়।
সূত্র:ইউরো নিউজ
পিএ/টিএ