ইরানে আশুরা উদযাপন করা হয় যেভাবে

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনে পালিত হয় আশুরা। বিশ্বের সুন্নী মুসলিমরা আশুরাকে রোজা ও ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করেন। তবে শিয়া মুসলিমরা বিভিন্ন আয়োজনে আশুরা পালন করেন। শিয়াদের আশুরা উদযাপনের মধ্যে তাজিয়া, শোক মিছিল, কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে নিজেদের আঘাত করা উল্লেখযোগ্য।

শিয়া প্রধান দেশ ইরানে আশুরা উদযাপনে দেখা যায় বৈচিত্র্যপূর্ণ দৃশ্য। ইরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশুরা পালন করা হয়। তবে রাষ্ট্রীয় আশুরা উদযাপনের চিত্র মূলত একধরনের আদর্শিক এবং রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। রাষ্ট্রীয় চিত্রের বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বহু ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যময় রীতি রয়েছে। এর কিছু অবহেলিত, কিছু নিষিদ্ধ, তবে এখনো সেগুলো অনেক ইরানির বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অংশ।

ইরানে আশুরায় কালো পোশাক পরা শোকাহত মানুষের মিছিল এবং শোকের চিত্র দেখা যায়। বিবিসি পারসিয়ানের সংবাদদাতা সিয়াভাশ আর্দালান জানান,এই চিত্র মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি জোরদার বার্তা প্রদান করে এবং এর মাধ্যমে ধর্মীয় নেতৃত্বের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠানে আশুরা উদযাপনের একেবারে ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে।

ইরানে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে আশুরা-
আশুরা ও আশুরার আচার-অনুষ্ঠান শিয়া মুসলিমদের কাছে সম্পূর্ন আবেগপূর্ণ একটি বিষয়। তাই ইরানে আশুরা উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, কারণ আশুরাকে রাষ্ট্রের মতাদর্শের প্রেরণার মূল উৎস বলে মনে করা হয়।

ইরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশুরার কিছু অনুষ্ঠানকে সমর্থন ও প্রচার করা হয়, কিছু উপেক্ষা করা হয়, আবার কিছু রীতিনীতি নিষিদ্ধও করা হয়েছে।

শিয়া ধারণা অনুযায়ী, রাসুল (সা.) এ নাতি হুসাইন (রা.) ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে আশুরার দিনে ন্যায়ের পক্ষে এক যুদ্ধে জড়ান। তিনি জানতেন যে তিনি ও তার অনুসারীরা শহীদ হবেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নিতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই তিনি যুদ্ধ করেন।

রাষ্ট্রের নিজস্ব বার্তা-
ইরানি সরকার বর্ণনা অনুযায়ী, আশুরা মূলত প্রতিরোধ ও বীরত্বের প্রতীক। ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি একবার বলেছিলেন, ‘আশুরার শিক্ষা হচ্ছে সংলাপ ও যুক্তির শিক্ষা’।
কিছু ভিন্নমতাবলম্বী আলেম আশুরাকে সহনশীলতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তবে তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আশুরার আনুষ্ঠানিক চিত্র-
ইরানের আলেমরা আশুরাকে সরকারের নির্ধারিত গাইডলাইন অনুসরণ করে পালনের কথা বলেন। আশুরার উদযান উপলক্ষে অনেকে কালো পোশাক পরেন, বুকে এবং মাথায় আঘাত করেন, একজন আলেম আবেগঘন ভঙ্গিতে আশুরার গল্প বলেন। এবং অনেক সময় অতিরঞ্জিত গল্প বলেন।

এভাবে এই আচার-অনুষ্ঠানকে একদিকে আলেমদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় বার্তাও এতে যুক্ত করা যায়।

ইরান সরকার অনুমোদিত আশুরা অনুষ্ঠানের মধ্যে আরেকটি চিত্র এমন রয়েছে, যেখানে মা-বাবারা তাদের শিশুকে নিয়ে আশুরার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং হুসাইন (রা.)-এর শহীদ শিশুদের স্মরণ করেন। ১০ বছর আগে রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর সূচনা হয়। বর্তমানে ইরানের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই উদযাপন। এই রীতিকে ইউনেস্কোতে ইরানি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে নিবন্ধনেরও চেষ্টা করা হয়েছে।
আশুরা উদযানের গ্রামীণ ও ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি

ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ও ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতিতে আশুরা পালিত হয়। যেমন—
বুশেহর : সমুদ্রের পানিতে নাট্যসামগ্রী ধোয়া।
শাহরে কুর্দ : মোমবাতি নিয়ে পাহাড়ে প্রার্থনাযাত্রা।
বিজার ও খোরামআবাদ : গোলাপজল মেশানো কাদা মেখে মাতম।
আর্দেবিল: পানি ভর্তি পাত্র বহন।
খোমেইনি-শাহর : বর্ণিল পোশাকে শিশুরা উৎসবে অংশ নেয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব রীতিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে সাধারণ ইরানিদের অনেকে দেশের এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয়ে প্রায় জানেই না।

আশুরা উপলক্ষে কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে নিজেকে আঘাত করে উদযাপনের দৃশ্য দেখা যায়। পূর্বে অনেক আলেম আশুরা পালনের এই রীতি সমর্থন করতেন। তবে বর্তমানে এসব রীতিকে ‘উগ্রতা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘গামে-জানি’ (মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতাও ফতোয়া জারি করে একে হারাম ঘোষনা করেছেন।

আশুরা ভেবে আগে বিভিন্ন আবেগঘন, কল্প কাহিনীর প্রচলিত ছিল। বর্তমানে আলেমদের মাধ্যমে এসব ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হয় এবং সত্য ঘটনা প্রচলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়।

সূত্র : বিবিসি 

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজাদের রাজত্ব করার দিন শেষ, এখন হিসাব নেয়ার সময় এসেছে: সারজিস আলম Oct 11, 2025
img
বাগদান সারলেন তানজীব সারোয়ার Oct 11, 2025
img
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেন্টাল হেলথ সার্ভিস চালুর চেষ্টা করবে সরকার: গণশিক্ষা উপদেষ্টা Oct 11, 2025
img
গাজায় যুদ্ধবিরতি হতে না হতেই, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ইসরায়েলের হামলা Oct 11, 2025
img
১৫ নয় ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হবে জুলাই জাতীয় সনদ Oct 11, 2025
img
কোনো দুর্নীতিবাজ বিএনপির সদস্য হতে পারবে না : রিজভী Oct 11, 2025
img
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চাই, তবে সেটা সমতার: মির্জা ফখরুল Oct 11, 2025
img
চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম Oct 11, 2025
img
রোববার থেকে শেখ হাসিনার মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু, হবে সরাসরি সম্প্রচার Oct 11, 2025
img
সপ্তম জাতীয় মানবসম্পদ সম্মেলন ৫ ডিসেম্বর Oct 11, 2025
img

মোস্তফা ফিরোজ

কমিশন কি পারবে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে? Oct 11, 2025
img
নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ বিএনপি : মীর হেলাল Oct 11, 2025
img
সৈকতের নিভৃতে মাহিকার সঙ্গে দেখা গেল হার্দিককে Oct 11, 2025
img
গুমের ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন সালাহউদ্দিন Oct 11, 2025
img
সংবাদকর্মীদের ভোটকক্ষে প্রবেশে কোনো বাধা থাকা উচিত নয় : সাখাওয়াত হোসেন Oct 11, 2025
img
অপরাধীদের বিচার ও বাহিনী সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব : আখতার Oct 11, 2025
মুনাফিকের ভয়াবহ পরিণতি | ইসলামিক জ্ঞান Oct 11, 2025
যেভাবে ইসলাম প্রচার করবেন | ইসলামিক টিপস Oct 11, 2025
১ মাসের মধ্যে শেষ হবে বিপিএল, থাকবে ৫ টা দল: ইফতেখার মিঠু Oct 11, 2025
বিপিএলে বড় পরিবর্তন, ফরচুন বরিশাল কি থাকবে মাঠে? Oct 11, 2025