মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নারীরা এক সময় গড়ে সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন, কিন্তু ২০১০ এর দশকের শুরুতে তা নেমে এসেছে মাত্র তিনটিতে। এর কারণ কী এবং ভবিষ্যতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে— তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে।
বিশ্বব্যাপী জন্মহার সংকট এখন একটি বাস্তবতা। গত মাসে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) কর্তৃক ১৪টি দেশে ১৪ হাজার মানুষের এক জরিপে দেখা গেছে, পাঁচজনের মধ্যে একজন তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান নিতে পারেননি বা পারবেন না।
ইউএনএফপিএর প্রধান ডা. নাতালিয়া কানেম বলেছেন, “বিশ্ব এখন জন্মহারের এক অভূতপূর্ব পতনের মুখোমুখি। বিশ্বের প্রতিটি কোণে – ধনী ও দরিদ্র দেশে, উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় সমাজে জন্মহার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান 'নীরব বিপ্লব' এই বৈশ্বিক সংকটের একটি অংশ মাত্র।”
এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তন আরও তাৎপর্যপূর্ণ। টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট জন্মহার ১৯৬০ এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। এই অঞ্চলের নারীরা একসময় গড়ে সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন, কিন্তু ২০১০ এর দশকের শুরুতে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিনটিতে।
২০১৬ সালে গবেষকরা জানিয়েছেন যে মধ্যপ্রাচ্য ‘গত ৩০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জন্মহার হ্রাস’ দেখছে। মধ্যপ্রাচ্য ফার্টিলিটি সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের দেশগুলিতে মোট জন্মহার ৩.৮% থেকে ২৪.৩% পর্যন্ত কমেছে।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আরব লীগের ২২টি সদস্য দেশের মধ্যে পাঁচটি দেশের জন্মহার ২.১ এর নিচে। উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্মহার মাত্র ১.২ – এটি এমনকি জার্মানির গড় জন্মহার ১.৩৮-এর চেয়েও কম।
এই পরিবর্তনকে 'নীরব বিপ্লব' বলার কারণ হল এটি ঘটছে মানুষের ঘরের গোপনীয়তায়, কোনো রাজপথের বিক্ষোভ বা সরকার পতন ছাড়াই। কিন্তু এর প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছাচ্ছে।
যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় জর্জরিত এই বিপজ্জনক পৃথিবীতে অনেকেই আর নতুন প্রাণ আনতে চান না। মিসর ও জর্ডানে জাতীয় ভরতুকি প্রত্যাহার, মুদ্রাস্ফীতি এবং তেলসমৃদ্ধ দেশগুলিতে সরকারি চাকরির সুযোগ কমে যাওয়ায় বিবাহ ও সন্তানের খরচ বহন কঠিন হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষভাবে দ্রুত অনুভূত হচ্ছে, যা তরুণ দম্পতিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
আরও গভীর পরিবর্তন ঘটছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে। গর্ভনিরোধক এবং বিবাহবিচ্ছেদের বর্ধিত প্রাপ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা (এমনকি ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মধ্যেও), নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, এবং নগরায়নের প্রভাব পারিবারিক কাঠামোকে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত করছে।
জর্ডান ও মিসরের গ্রামীণ এলাকায় জন্মহার বড় শহরগুলির তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা নগরায়নের প্রভাব স্পষ্ট করে। সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে ‘পশ্চিমা জীবনযাত্রা’ সম্পর্কে তথ্যের প্রবেশ আদর্শ পারিবারিক জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন করছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্সিয়া ইনহর্ন এই পরিস্থিতিকে ‘ওয়েটহুড’ অর্থাৎ প্রতীক্ষার সময় বলে বর্ণনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিবাহের রীতিতে বরের পক্ষ থেকে সোনার গহনা, নগদ অর্থ বা সম্পূর্ণ সজ্জিত বাড়ি প্রদানের প্রথা রয়েছে। কিন্তু তরুণরা এই অর্থনৈতিক সামর্থ্য রাখেনা, তাই তারা বিবাহের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। একই সাথে, এই অঞ্চলের নারীদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ সঠিক সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছেন বা বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
অ্যামেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা হিসাব করেছেন যে মানুষের জন্মহার ইতিমধ্যে প্রতিস্থাপন হারের নিচে নেমে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই 'নীরব বিপ্লব' কেবল সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের মোট জন্মহার ১.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউএনএফপিএ -এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ৩৬% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সম্মুখীন হন, আবার ৩০% তাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তান সংখ্যা অর্জনে ব্যর্থ হন। গত বছর টোকিওর স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ২০২৩ সালে মাত্র ৭২৭,২৭৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে এবং প্রজনন হার ১.২-এ নেমে এসেছে।
প্রতিস্থাপন হারের নীচে যাওয়া কিছু দেশের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা উদ্বেগজনক। এর ফলে আগামী প্রজন্মে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সমাজ বয়স্ক হয়ে উঠবে – স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলির মতো আর্থিক সামর্থ্য ছাড়াই।
এই সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রোনাটালিজম শুরু হয়। ইলন মাস্ক এর অন্যতম প্রবক্তা। মাস্ক, যার নিজের ১৪টি সন্তান, সম্প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছেন, “প্রায় সব দেশেই জন্মহার খুবই কম, এবং এটি পরিবর্তন না হলে সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন একটি প্রগতিশীল সমাজের জন্য উপযুক্ত বলে বোধ হয় বিবেচনা করা যায়না। জন্মহার হ্রাসের কারণ গুলোর মধ্যে নারী শিক্ষার হার ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বার বার উল্লেখিত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং জনসংখ্যার হার নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ একটা মৌলিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।
তবে ওয়াশিংটন-এর এক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ নিকোলাস এবারস্ট্যাড এটিকে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন।তার মতে, “জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আসলে একটি স্বাস্থ্য বিস্ফোরণ ছিল।"স্বাস্থ্যসেবার এই সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, শিক্ষা ও জ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে।”
“এবং জনসংখ্যা হ্রাসের সাম্প্রতিক সব চিত্র ভবিষ্যতে মানব সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উন্নত করবে। মানব প্রজাতি জানে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়।”
মধ্যপ্রাচ্যের 'নীরব বিপ্লব' বিশ্বব্যাপী জনতাত্ত্বিক রূপান্তরের একটি প্রতীক মাত্র। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যানগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের লক্ষণ।
এবারস্ট্যাড বলেন, “মানুষ ইতিহাসের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে চলেছে - জনসংখ্যা হ্রাসের যুগে।”
এবারস্ট্যাডের এই ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো আমাদের সন্তান-সন্ততিদের বাস্তবতা হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হল, আমরা কি এই নতুন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত? এই'নীরব বিপ্লব'হয়তো আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
এফপি/ টিএ/ টিকে