বিবিয়ানায় গ্যাস উৎপাদনে ধস, একদিনের ব্যবধানে কমেছে ৫৭ লাখ ঘনফুট

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় একদিনের ব্যবধানে গ্যাস উৎপাদন কমেছে ৫৭ লাখ ঘনফুট। ৩১ জুলাই যেখানে দেশীয় সব গ্যাসক্ষেত্র মিলিয়ে উৎপাদন ছিল ১৮০৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ঘনফুট, ১ আগস্ট তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭৭৬ মিলিয়নে। শুধু বিবিয়ানা নয়, একযোগে কমেছে অন্যান্য ক্ষেত্রের উৎপাদনও, যা এক দিনে ১ কোটি ৪৭ লাখ ঘনফুট হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা যেখানে দিন দিন বাড়ছে, সেখানে দেশীয় উৎপাদন টিকিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৪ সালের ১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ১৬টি গ্যাস ফিল্ডের ৭৩টি কূপ থেকে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন ছিল ৮০১ মিলিয়ন ঘনফুট, এক বছর পর তা নেমে এসেছে ৬৯৬ মিলিয়নে। একই সময়ে বিদেশি মালিকানাধীন চারটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন ১২২৭ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭৯ মিলিয়নে। সব মিলিয়ে এক বছরে দেশের সামগ্রিক গ্যাস উৎপাদন কমেছে ২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট।

বর্তমানে শেভরন বাংলাদেশের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৬টি কূপ দিয়ে দৈনিক উত্তোলন হচ্ছে ৯০৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যেখানে সমানসংখ্যক কূপ থাকলেও তিতাস গ্যাসক্ষেত্র দিচ্ছে মাত্র ৩১২ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি তিতাসে গ্যাস মজুদ ছিল ১.৯১ টিসিএফ এবং বিবিয়ানায় ছিল ১.৬১ টিসিএফ। প্রতিদিন প্রায় এক বিসিএফ হারে উত্তোলনের ফলে বিবিয়ানার মজুদ বর্তমানে ১ টিসিএফের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, হবিগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুন্দলপুর, বিয়ানীবাজার, সালদানদীসহ অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রেও মজুদ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। শেভরনের মালিকানাধীন জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে অবশিষ্ট মজুদ মাত্র ৭৯৭ মিলিয়ন ঘনফুট। উৎপাদন বাড়াতে সেখানে কমপ্রেসর স্থাপনের পরিকল্পনা থাকলেও বিল বকেয়া থাকার কারণে প্রকল্পটি আটকে ছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে বকেয়া পরিশোধের পর আলোচনা আবার শুরু হয়েছে। শেভরন জানিয়েছে, প্রকল্পটি শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। কমপ্রেসর বসানো গেলে দৈনিক প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে গ্যাসের সীমিত মজুদ থাকায় বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়টি এখন প্রায় অবধারিত। তবে বিগত সরকারগুলোর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার অনুসন্ধান না করে আমদানির দিকেই ঝুঁকেছিল। মহেশখালীতে তৃতীয় এলএনজি টার্মিনাল, পায়রায় ভাসমান টার্মিনাল, ভারত থেকে আমদানির জন্য পাইপলাইন প্রকল্পসহ একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে বিশেষ বিধান আইনের আওতায় থাকা এসব প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমদানি সক্ষমতাও ১১০০ মিলিয়নের মধ্যে সীমিত হয়ে আছে। নতুন এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে চাইলে ভাসমান হলে ২৪ মাস এবং স্থলভিত্তিক হলে ৮০ মাসের মতো সময় লাগবে।

দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে এখন ১০০ কূপ খননের নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ এবং ৩১টি পুরাতন কূপের ওয়ার্কওভার রয়েছে। এসব প্রকল্প ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও বাছাই করা ১৯টি কূপ দ্রুত খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে জানান, দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান জোরদার করা হয়েছে, নতুন দুটি রিগ কেনা হচ্ছে এবং আরও দু’টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সূফী গণমাধ্যমকে বলেন, বিবিয়ানার উৎপাদন হ্রাস পাওয়া উদ্বেগজনক। চাপ কমে যাওয়ায় কূপে কমপ্রেসর ব্যবহার করা হচ্ছে, যেকোনো সময় বড় ধরনের ধস দেখা দিতে পারে। কিন্তু সেই শঙ্কা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। আমদানি বাড়ানোরও সুযোগ সীমিত। ফলে বর্তমান উৎপাদন অব্যাহত রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০২৬ সালের শেষ দিকে বিবিয়ানার উৎপাদন ৫০০ মিলিয়নের নিচে নেমে আসতে পারে। সেই পরিস্থিতি এলে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন নেমে যাবে দেড় হাজার মিলিয়নের নিচে, যা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এফপি/ টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মঙ্গলবার বিকেলে সংসদ প্রাঙ্গণে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা Aug 04, 2025
img
চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু Aug 04, 2025
img
বাংলাদেশকে হালাল পণ্যের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে সরকার Aug 04, 2025
‘যেকোনো সময়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত বিএনপি’ Aug 04, 2025
img
বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানকে শুভেচ্ছা জানালেন ফিফা সভাপতি Aug 04, 2025
img
মালায়ালাম থেকে তামিল-তেলেগু ছবিতে মালবিকার জয়যাত্রা Aug 04, 2025
আমি গরিবের ছেলে, লোভ সামলাতে পারিনি’—রিয়াদের জবানবন্দি প্রকাশ্যে Aug 04, 2025
img
ওভালে অবিশ্বাস্য জয় ভারতের, সিরিজ ড্র Aug 04, 2025
img
এবার ট্রাম্পকে নোবেলের জন্য মনোনীত করল কম্বোডিয়া Aug 04, 2025
img
এআই দিয়ে রানঝানার কাহিনী বদলে দেওয়ায় উত্তাল দর্শকমহল Aug 04, 2025
img
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষ্যে যেসব সড়ক এড়িয়ে চলতে বললো ডিএমপি Aug 04, 2025
img
শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণের দাবি জানাল জামায়াত Aug 04, 2025
ড. ইউনূসের দল নিয়ে আস্থা হারালেন রেজা কিবরিয়া Aug 04, 2025
img
১০ আগস্ট খসড়া ও ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে ইসি Aug 04, 2025
img
‘নির্বাচন পূর্ববর্তী অবস্থা পর্যবেক্ষণে সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আসছে ইইউ প্রতিনিধি দল’ Aug 04, 2025
img
আমরা চাই না কেউ অভুক্ত থাকুক : ট্রাম্প Aug 04, 2025
মাহাদী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার তিন নেতা Aug 04, 2025
‘ছাত্রলীগের ছদ্মবেশে নির্যাতনে জড়িত ছিলেন শিবির নেতাকর্মীরা’ Aug 04, 2025
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Aug 04, 2025
img
বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধে এক বছরে কলকাতার অর্থনীতিতে ক্ষতি ৫০০০ কোটি! Aug 04, 2025