১৯৭১ সালের ১১ই নভেম্বর, নিউ ইয়র্ক শহরের কেন্দ্রস্থল ফিফথ অ্যাভিনিউর বিখ্যাত বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্ট স্টোর বার্গডফ গুডম্যান-এ আয়োজিত হয়েছিল এক রাজকীয় ফ্যাশন শো ও নৈশভোজ। সম্মানিত অতিথি ছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাজ্য সিকিমের রাজা চোগিয়াল পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়াল ও তার মার্কিন স্ত্রী রানি হোপ কুক।
সেদিন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল সিকিমের ঐতিহ্যবাহী রীতিতে, পশমি স্কার্ফ দিয়ে। ভিতরে সিকিমি সংগীত আর শ্যাম্পেন, বাইরে ম্যানহাটনের রাস্তা সেজে উঠেছিল সিকিমের পতাকায়।শহরের অভিজাত, সেলিব্রিটি, ফ্যাশন জগতের তারকারা সেই সন্ধ্যায় হাজির ছিলেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভাষায়, ‘রানি হোপ ফ্যাশনকে ব্যবহার করছেন নিজের দেশের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে।’ এই আয়োজন আসলে ছিল সিকিমকে বিশ্বমঞ্চে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা। তখনই রাজা বুঝে গিয়েছিলেন — ভারত সরকারের মনোভাব বদলেছে, দিল্লি হয়তো সিকিমকে ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে।
এই উদ্দেশ্যেই কয়েক মাস আগে রাজা ও রানি ভারতে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করেন সিকিমের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে। ছবির লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, সিকিম শুধুই একটি ভূখণ্ড নয়, বরং একটি অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়। যদিও রাজনীতি ও সেন্সরের কারণে বহু বছর সেই তথ্যচিত্র সাধারণ মানুষ দেখতে পায়নি। তবে কেউই তখন ভাবেননি নিউ ইয়র্কের সেই জাঁকজমকপূর্ণ সন্ধ্যার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ইতিহাস মোড় নেবে অন্যদিকে।
এই ঐতিহাসিক পালাবদলের কেন্দ্রে ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। তিনি সিকিমের রাজনীতির অন্যতম মুখ, রাজার চির প্রতিদ্বন্দ্বী, ও পরে রাজ্যটির প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আজও বিতর্কিত। একপক্ষের চোখে তিনি নায়ক, আরেকপক্ষের দৃষ্টিতে ভারতীয় ‘এজেন্ট’। তবে ইতিহাস বলে, তার সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া সিকিমের এই পরিণতি সম্ভব হতো না।
সিকিমে রাজতন্ত্রের সূচনা সপ্তদশ শতাব্দীতে, তখন রাজ্যকে ভাগ করা হয় ১২টি প্রশাসনিক এককে (জং), যার প্রতিটির দায়িত্বে থাকতেন একজন কাজী। দক্ষিণ সিকিমের চুকাং অঞ্চলের কাজীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন খাংসারপা লেপচা পরিবার, যার সন্তান ছিলেন লেন্দুপ দর্জি। তরুণ বয়সেই তিনি সিকিমের প্রধান তিব্বতি বৌদ্ধ মঠ রুমটেক-এর প্রধান হন। তবে এটি ছিল অস্থায়ী পদ। মাত্র ১০ বছর বয়সে যুবরাজ পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়ালকে ওই পদে বসানো হলে লেন্দুপ দর্জি সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই ক্ষোভই হয়তো রাজার প্রতি তার বিরোধের শুরু।
এদিকে সিকিমে রাজতন্ত্রের নেতৃত্বে ছিলেন লেপচা ও ভুটিয়া এলিটরা, অথচ জনসংখ্যার বড় অংশ ছিলেন নেপালি অভিবাসী — বঞ্চিত, প্রান্তিক। লেন্দুপ দর্জি জমিদার হয়েও নেপালিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতেন, যা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন সিকিমের রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। লেন্দুপ দর্জি ১৯৪৫ সালে গঠন করেন সিকিম প্রজা মণ্ডল, যা পরে হয়ে ওঠে সিকিম স্টেট কংগ্রেস এবং পরবর্তীতে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনিই ছিলেন প্রধান মুখ।
তবে যতদিন না ভারত নিজের অবস্থান বদলাচ্ছিল, ততদিন তিনি রাজাকে চ্যালেঞ্জ করে বাস্তব কিছু করতে পারছিলেন না। কারণ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সিকিমকে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েই রাখতে চেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। চীন তখন চুম্বি উপত্যকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে পড়েছিল এবং ভুটান জাতিসংঘে সদস্যপদ পেয়ে গেছে। ইন্দিরা গান্ধী বুঝেছিলেন, সিকিমকেও স্বাধীন রাখলে ভবিষ্যতে তা ভারতের জন্য কৌশলগত হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে সিকিম নিয়ে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।
র-এর সাবেক প্রধান জিবিএস সিধু তার বই ‘সিকিম: ডন অফ ডেমোক্রেসি’-তে উল্লেখ করেন, কীভাবে ১৯৭২ সালে সরাসরি দর্জির সঙ্গে যোগাযোগ করে গোয়েন্দারা শুরু করেন এক গোপন অপারেশন। তাদের লক্ষ্য, সিকিমকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা। খুব গোপনে এরপর সিকিমের গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে একজোট করার কাজ শুরু হল, তাদের বোঝানো হল যে ভারত আর চোগিয়ালকে সমর্থন করবে না। এখান থেকেই কাজী লেন্দুপ দর্জির সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে ভারতের আর্থিক ও অন্য সব ধরনের সাহায্য যোগানো শুরু হল।
লেন্দুপ দর্জির সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে আর্থিক, সাংগঠনিক, এমনকি নির্বাচনী সহায়তা দিতে থাকে ভারত। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে সেই দল ৩২টির মধ্যে ৩১টি আসনে জয় পায়। দর্জি হন সিকিমের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এরপরের ইতিহাস শুধুই সময়ের অপেক্ষা। এপ্রিলের মধ্যেই রাজ্যসভা দুটি প্রস্তাব পাস করে: ভারতের সঙ্গে সংযুক্তি ও চোগিয়ালের অপসারণ। ১৪ এপ্রিল হয় গণভোট – যেখানে ৯৭.৫৫ শতাংশ মানুষ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। অবশেষে ১৬ মে, ১৯৭৫ সালে ভারতের ২২তম রাজ্য হয়ে ওঠে সিকিম।
আজও অনেকেই কাজী লেন্দুপ দর্জিকে ভারতের এজেন্ট বলে অভিযুক্ত করেন। রাজা চোগিয়ালের এডিসি ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়ংডার দাবি, গণবিক্ষোভে ভারতীয় সেনারা সিভিল ড্রেসে অংশ নিতেন, গণভোটও ছিল রিগ করা। তবু অস্বীকার করা যায় না, সিকিমের নেপালি জনগণের এক বড় অংশ লেন্দুপ দর্জিকে ‘মুক্তিদাতা’ বলেই মনে করেন। তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সকল নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করেছিলেন।
চোগিয়ালের পতনের পর তার দাম্পত্য জীবনও ভেঙে পড়ে। রানি হোপ কুক ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। চোগিয়াল নিজের জীবন শেষ করেন নিঃসঙ্গতা আর হতাশায়, আর লেন্দুপ দর্জি সিকিমের বাইরে, অনেকটাই বিস্মৃত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ২০০৭ সালে।
সিকিমের ইতিহাসে দুই বিদেশিনী নারী বেশ আলোচিত। তারা হলেন, কাজী লেন্দুপ দর্জির স্ত্রী এলাইজা-মারিয়া এবং সিকিমের চোগিয়ালের স্ত্রী হোপ কুক। কাজী লেন্দুপের স্ত্রী এলাইজা-মারিয়া ল্যাংফোর্ড রাই ছিলেন বেলজিয়ান অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়াশোনা শেষ করে তিনি প্রথমে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর বার্মায় বসবাস শুরু করেন। তার প্রথম স্বামী ছিলেন স্কটিশ। বিবাহ বিচ্ছেদের পর দিল্লিতে ১৯৫৭ সালে কাজী লেন্দুপের সঙ্গে তার পরিচয় ও পরবর্তীতে বিয়ে হয়। সিকিমে তিনি ‘কাজীনী এলাইজা মারিয়া’ নামেই পরিচিত ছিলেন।
বিয়ের পর থেকেই তার লক্ষ্য ছিল একদিন সিকিমের ‘ফার্স্ট লেডি’ হওয়া। কালিম্পংয়ে বসেই তিনি সিকিমের রাজপরিবারকে আক্রমণ করে নানা লেখা প্রকাশ করতেন দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে। ভারতের জনমত গঠনে ও স্বামীর রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করতে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
কাজীর সঙ্গে বিবাহের ছয় বছর পর কাজীনীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন সিকিমের যুবরাজ থেনডুপ নামগিয়ালের নতুন প্রেমিকা—আমেরিকান ধনাঢ্য পরিবারের তরুণী হোপ কুক। ১৯৫৯ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে গবেষণার কাজে ভারতে আসেন হোপ এবং দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান হোটেলে যুবরাজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। যুবরাজের প্রথম স্ত্রী তখন প্রয়াত, ফলে পরিচয় প্রেমে রূপ নেয়। ১৯৬৩ সালে জওহরলাল নেহরুর সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়। হোপ তখন মাত্র ২২ বছরের তরুণী। বিয়ের অল্প কিছুদিন পর থেনডুপ চোগিয়ালের সিংহাসনে বসেন এবং হোপ সিকিমের নতুন রানি ‘গিয়ালমেও’ হন।
এই আমেরিকান রানিকে ঘিরে শীতল যুদ্ধের সময় ভারতে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। অনেকে তাকে সিআইএ-এর গুপ্তচর বলে সন্দেহ করলেও পরবর্তীতে প্রমাণ মেলেনি। তবু ভারতীয় সাধারণ মানুষ তা সহজে বিশ্বাস করেনি।
চোগিয়াল দম্পতি প্রায়ই আন্তর্জাতিক সফরে যেতেন স্বাধীন সিকিমের পক্ষে জনসংযোগ বৃদ্ধির জন্য। ১৯৬৬ সালে হোপ কুক ‘বুলেটিন অব টিবেটোলজি’তে দার্জিলিংকে সিকিমের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানালে ভারতীয় সংসদে তুমুল আলোড়ন ওঠে। ১৯৬৭ সালে তার অনুপ্রেরণায় চোগিয়াল একটি ‘স্টাডি ফোরাম’ গঠন করেন, যা স্বাধীন সিকিমের পক্ষে মতামত তৈরির জন্য কাজ করত।
ভারত তখন থেকেই হোপ কুককে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। ১৯৬৮ সালের স্বাধীনতা দিবসে গ্যাংটকে স্কুলশিশুরা যখন ‘ভারতীয়রা সিকিম ছাড়ো’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করে। গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন হোপ কুক। ফলে, একদিকে কাজীনী এলাইজা মারিয়া স্বামীর সঙ্গে থেকে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করছিলেন, আরেকদিকে হোপ কুক নিজের সাংগ্রিলার স্বাধীনতার স্বপ্নে লড়াই চালাচ্ছিলেন। ইতিহাসের রায়ে জয়ী হন কাজীনী।
ভারত সিকিম দখল করার প্রায় দেড় বছর আগেই হোপ কুক সন্তানদের নিয়ে চিরতরে আমেরিকায় ফিরে যান। এরপর আর তিনি কখনো সিকিমে আসেননি। ভারতীয় সেনারা রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করছে, এ দৃশ্যও তাকে দেখতে হয়নি। অন্যদিকে এলাইজা মারিয়া জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজী লেন্দুপের পাশে ছিলেন। নিঃসন্তান এই দম্পতি কালিম্পংয়েই বসবাস করতেন, সেখানেই ১৯৯০ সালে কাজীনীর মৃত্যু হয়।
কাজী লেন্দুপ দর্জি সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলেও তার সেই ক্ষমতা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৯তে সিকিমের পরের নির্বাচনে তার দল এসএনসি একটিও আসন পায়নি, মুখ্যমন্ত্রী হন নেপালি জনজাতি থেকে উঠে আসা এক নতুন নেতা নরবাহাদুর ভান্ডারী। দর্জির সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের কার্যত সেখানেই ইতি। কয়েক বছর পর একবার সিকিমের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে তিনি দেখেন ভোটার তালিকায় তার নামই নেই।
ততদিনে তিনি সস্ত্রীক সিকিম লাগোয়া কালিম্পং-য়ে ‘চুকাং হাউজ’ নামে একটি বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছেন, যেটির নামকরণ করা হয়েছিল তাদের পুরনো জমিদারির নামে। ১৯৯০তে স্ত্রীর মৃত্যুর পর জীবনের শেষ সতেরো বছর তিনি সেখানেই একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। দেখাশুনোর জন্য পুত্র-পরিজন বা আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না, তিনি নিজেও সিকিমের সঙ্গে সব যোগাযোগ কার্যত ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।
মৃত্যুর বছর চারেক আগে ভারত সরকার অবশ্য তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মবিভূষণে’ সম্মানিত করেছিল। ২০০৪ সালে সিকিম রাজ্য সরকার দিয়েছিল ‘সিকিম রত্ন’ সম্মানও। শেষ জীবনে তার প্রতি ভারত সরকারের মনোভাব নিয়ে তিনি যে রীতিমতো ব্যথিত ও আশাহত ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। এটা কোনো গোপন কথা নয়।
১৯৯৬ সালের নভেম্বরে তিনি নেপালের জনপ্রিয় দৈনিক কান্তিপুর টাইমসের সম্পাদক সুধীর শর্মাকে একটি সাক্ষাতকার দেন, যাতে তিনি দিল্লির বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ ও আশাভঙ্গের বেদনা উগরে দিয়েছিলেন।
সুধীর শর্মা পরে লিখেছেন, ‘কাজ শেষ হওয়ার পরে ভারত যে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এটা লেন্দুপ দর্জি দিব্বি বুঝেছিলেন। আমার কাছে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন আগে দিল্লি গেলে লাল কার্পেট বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হতো, প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে লম্বা লম্বা বৈঠক করতাম। আর আজকাল দিল্লিতে গেলে দ্বিতীয় সারির নেতা-মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়।’
লেন্দুপ দর্জির জীবনের অন্যতম বড় অভিযোগ, নিজের দেশকে ভারতের হাতে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কী বলতেন? সাংবাদিক সুধীর শর্মার বর্ণনায়, এক সাক্ষাৎকারে লেন্দুপ দর্জি বলেছিলেন, ‘অনেকেই আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে। বলে আমি নাকি সিকিমকে বেচে দিয়েছি। তর্কের খাতিরে যদি মেনে নিই যে এ অভিযোগ সত্যি, তবে কি সিকিমের আজকের অবস্থার জন্য কেবল আমিই দায়ী? চোগিয়ালের অপশাসনের কথা কি ভুলে যাবেন?’ তার ইঙ্গিত স্পষ্টতই ছিল সারা জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী চোগিয়ালের শাসনের দিকে।
কিন্তু ইতিহাসের পরিণতি চোগিয়ালের জন্যও সুখকর হয়নি। স্ত্রী আগেই তাকে ছেড়ে চলে যান। সিংহাসন হারানোর মাত্র তিন বছরের মাথায় কেমব্রিজে শিক্ষিত প্রথম পক্ষের পুত্র যুবরাজ তেনজিং নামগিয়াল গ্যাংটকে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
এর চার বছর পর মাত্র ৫৮ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিকিমের শেষ চোগিয়াল পালডেন থোন্ডুপ নামগিয়াল। তারও আড়াই বছর পর নিজের শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে দিল্লিতে প্রাণ হারান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অন্যদিকে কাজী লেন্দুপ দর্জির জীবন ছিল দীর্ঘায়ুর। শতবর্ষ পার করে ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই কালিম্পংয়ের নিজ বাসভবনে তিনি ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর পর তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সিকিমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং বলেন, ‘কাজীসাহেবকে দেখেই আমি সিকিমের রাজনীতিতে আসি।’ মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর রুমটেক মঠে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়—যে মঠের প্রধানের পদ থেকে একসময় তাকে সরে যেতে হয়েছিল।
গ্যাংটকের প্রবীণ অধ্যাপক বিধুবিনোদ ভান্ডারীর মতে, ‘এই প্রজন্মের অনেক সিকিমিজ হয়তো কাজী লেন্দুপ দর্জির নামই শোনেনি’, তবে তার মতে অন্তত একটি কারণে আজকের সিকিমবাসীর তাকে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। লেন্দুপ দর্জির অনুরোধেই ভারত সরকার সিকিমের বাসিন্দাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আয়কর থেকে অব্যাহতি দেয়।
ভারতের মধ্যে আজও একমাত্র সিকিমের অধিবাসীরাই তাদের উপার্জনের ওপর আয়কর দেন না এবং এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজী লেন্দুপ দর্জির অবদান ছিল অপরিসীম। যে নেতাকে সারা জীবন নিজের মাতৃভূমিকে বিক্রির অভিযোগ শুনতে হয়েছে, তার জীবনের এই প্রাপ্তি কোনো অংশেই ছোট নয়।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এফপি/এসএন