মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের দক্ষিণে মেরুল্লা এলাকায় দেশটির জান্তা সরকার নতুন করে সেনা মোতায়েন করেছে। চলছে গোলাগুলি। এতে সেখানকার স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তে অবস্থান করছেন। ওপারের সংঘাতের গোলার শব্দও ভেসে আসছে এপারে। কক্সবাজারের উপকূলবর্তী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বসবাসরত রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে এ ধরনের খবর পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, এমন পরিপ্রেক্ষিতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘কিছু লোক সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। যেসব পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছে, সেখানে আমরা টহল বৃদ্ধি করেছি।’
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ফেরাতে কাল রোববার কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ঠিক তার আগ মুহূর্তে এ ঘটনার খবর এলো। ‘সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ’
টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জানান, ওপারে থাকা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে খবর এসেছে, তারা জান্তা সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশের জালিয়া দ্বীপের বিপরীতে মিয়ানমারের লালদিয়া নামক দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে।’
তবে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী-বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে শনিবার দুপুর পর্যন্ত তারা নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মো. জুবায়ের বলেন, ‘মংডু এলাকায় সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের শঙ্কায় অনেক রোহিঙ্গা লালদিয়াতে জড়ো হয়েছে। তারা সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে ‘
তিনি বলেন, ‘এর আগে আরাকান আর্মি ও জান্তা সৈন্যদের মধ্যে মংডু এলাকায় সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো হয়েছিল। গোলাগুলি ও বোমা হামলায় অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। তাই এবার তারা সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি এড়াতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে।’
আরাকান আর্মির নির্যাতন ও চাঁদাবাজি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন জুবায়ের।
টেকনাফের ২৭ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ কালাম বলেন, ‘শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মিয়ানমার নেভির একটি জাহাজে প্রায় ৩০০ জান্তা সেনা মেরুল্লা এলাকায় অবস্থান নেয়।’
দুপুর ২টার দিকে তারা স্থানীয়ভাবে ‘বিজিপি ক্যাম্প-৮’ নামে পরিচিত আরাকান আর্মির ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন আরাকান আর্মির সদস্য নিহত হয় এবং বাকিরা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘সংঘর্ষের পর স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে লালদিয়াতে আশ্রয় নেয় এবং বর্তমানে তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।’
মাঝি মোহাম্মদ কালাম এসব খবর তার স্বজন ও ওপারের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান।
টেকনাফে অবস্থানরত তিনজন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা নিশ্চিত করেছেন যে, জান্তা সেনারা মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তবে কতজন রোহিঙ্গা লালদিয়াতে আশ্রয় নিয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তাদের হিসেবে সংখ্যা ৪০০ থেকে ৭০০ এর মধ্যে হবে।
কিছুদিন আগে মংডু থেকে পালিয়ে আসা করিমুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাও জান্তা ও আরাকান আর্মির সংঘর্ষের খবরে শরণার্থীদের বাংলাদেশমুখী হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন।
কিন্তু শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তার কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।
তবে কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির সদস্যদের তৎপরতা বেড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দীন বলেছেন, এপারে নতুন করে অনুপ্রবেশের কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
ওপারে গোলাগুলির শব্দ
অনুপ্রবেশের আশায় ওপারে রোহিঙ্গাদের বসে থাকার খবরের মধ্যে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ফের গোলার শব্দ ভেসে এসেছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পায় সীমান্ত পাড়ের লোকজন।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরী লালু বলেন, “গত রাত থেকে আজ ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে সীমান্তের ওপারে কুমিরখালী, শীলখালী ও সাইডং এলাকা থেকে ব্যাপক গোলাবারুদের শব্দ পাওয়া গেছে। ফলে সীমান্তের কাছাকাছি চিংড়ির প্রজেক্টে থাকা লোকজন ভয়ে পালিয়ে এসেছে।”
তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ফের গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। ফলে আবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা রয়েছে।”
গোলার শব্দ পেয়েছেন একই ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডর মেম্বার হাজি জালাল আহমদ। তিনি বলেন, “আমি অসুস্থ। ভোরে উঠেছিলাম, তখন বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ পেয়েছি।”