এএফসি অ-২৩ চ্যাম্পিয়নশীপের বাছাই পর্বের এক ম্যাচ থাকতেই বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ অ-২৩ দল। অথচ ভিয়েতনামের এই টুর্নামেন্ট নিয়ে সর্বোচ্চ প্রস্তুতির ব্যবস্থা করেছিল বাফুফে। বাহরাইনে দুই সপ্তাহের অনুশীলন ও দু’টি প্রীতি ম্যাচ; সব মিলিয়ে এক মাসের অনুশীলন। যা বিগত সময় কখনো কোনো অ-২৩ টুর্নামেন্টের আগে হয়নি। শুধু প্রস্তুতিই নয়, ফুটবলারদের কোয়ালিটিতেও বিগত কয়েকটি অ-২৩ দলের চেয়ে এবারের মোরসালিন-জায়ানদের স্কোয়াড ভালো ছিল। এত সম্ভাবনা ও প্রস্তুতির পরও এমন ভরাডুবির জন্য ফুটবলাঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
বাফুফের পাঁচ জন নির্বাহী সদস্য ভিয়েতনামের স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে বাংলাদেশ অ-২৩ দলের দু’টি ম্যাচই দেখেছেন। ম্যাচের ফলাফল এবং টিম পারফরম্যান্সে সবাই হতাশ হয়েছেন। জাতীয় দল কমিটির সভায় অনেকে তাদের মতামত বা পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করবেন। তবে সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও নির্বাহী সদস্য গোলাম গাউস বিরক্ত ও হতাশ হয়ে সরাসরি কোচের খেলোয়াড় পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তুলেই ফেলেছেন, ‘একজন খেলোয়াড় পরিবর্তন করে খেলার চিত্র বদলে দেন কোচরা। সেখানেই কোচদের মুন্সিয়ানা বা কৃতিত্ব। আমাদের খেলোয়াড় পরিবর্তনগুলো সঠিক হয়নি। মোরসালিন অধিনায়ক এবং সে থাকা মানে আক্রমণে এগিয়ে থাকা।
তাকেও গুরুত্বপূর্ণ সময় তুলে নেয়া হয়েছে। খেলোয়াড় পরিবর্তনের সিদ্ধান্তগুলো ম্যাচ ও ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।’
গাউসের সঙ্গে একমত আরো অনেকেই। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি এত প্রস্তুতির পরও এমন ব্যর্থতায় কোচিং স্টাফের পাশাপাশি সিনিয়র ফুটবলারদেরও দায়ী করেছেন, ‘এক মাস ক্যাম্প, বাহরাইনে ম্যাচ খেলিয়ে ফেডারেশন চেষ্টার কমতি করেনি। এত কিছুর পরও খেলার মধ্যে সমন্বয়,পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। এটার দায় অবশ্যই কোচিং স্টাফের নিতেই হবে। পাশাপাশি যারা সিনিয়র দলে খেলেছেন এবং অ-২৩ দলে রাখা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা ছিল। সেটাও পূরণ হয়নি। দুই ম্যাচে গোল তো দুরের কথা, গতকাল মোরসালিনের দূরপাল্লার শট ছাড়া গোলের মতো তেমন আক্রমণও দেখা যায়নি।’
টানা দুই হারে বাংলাদেশ টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে। কোচ হাসান আল মামুন ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ফুটবলারদের জন্য এই টুর্নামেন্ট শিক্ষণীয় এবং ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা হিসেবে মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যেও নাখোশ হয়েছেন ফেডারেশনের কর্তারা। তাদের যুক্তি, অ-২৩ প্রায় জাতীয় দলই। এখানে পারফরম্যান্স করার ক্ষেত্র ১৪-১৯ বয়স ভিত্তিক পর্যায় শেখার জায়গা। কোচের এমন মন্তব্য যেন নিজের দায় এড়ানো।
অ-২৩ দলের আনুষ্ঠানিক হেড কোচ ছিলেন সাইফুল বারী টিটু। বাস্তবিক অর্থে এই দল পরিচালিত হয়েছে জাতীয় দলের স্প্যানিশ হেড কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার নির্দেশনাতেই। জাতীয় দলে তার সহকারী হাসান আল মামুন ক্যাবরেরার নির্দেশনা অনুযায়ী অ-২৩ দল পরিচালনা করেছেন। বাহরাইনে প্রীতি ম্যাচে মামুনই ডাগ আউটে ছিলেন। ২৩ দলের কোচ হতে এএফসি প্রো লাইসেন্স লাগে এজন্যই টিটুর শারীরিক উপস্থিতি। ভিয়েতনামে গিয়ে টিটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই মামুনই ছিলেন ডাগ আউটে। বিভিন্ন সুত্রের দাবি, একাদশ গঠন ও খেলোয়াড় পরিবর্তনের সময়ও নাকি ক্যাবরেরার দেওয়া। তাই ব্যর্থতার মূল দায়টা ক্যাবরেরাকেই দিচ্ছেন এমিলি।
এমিলি বলেন, ‘মামুন ভাই সামনে থাকলেও পেছনে কে ছিলেন সেটা সবারই জানা। মামুন ভাই তার নির্দেশনাই অনুসরণ করেছেন। ক্যাবরেরার যোগ্যতা-সামর্থ্য এবং বিচক্ষণতা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছে। ফলে তার সহকারী বিশেষ কিছু করবেন সেটা প্রত্যাশা করা বাস্তবিক নয়।’ এক্ষেত্রে তিনি মোহামেডানের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘শেন লে’র সহকারী ছিলেন আলফাজ ভাই। শেন ভালো মানের কোচ ছিলেন। তাকে কাছ থেকে দেখে আলফাজ ভাই মোহামেডানকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। যেখানে হেড কোচ ক্যাবরেরাই সফল নন এবং প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে তার সহকারীর কাছে কি আশা করা যায়।’
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কের সঙ্গে অনেকটাই একমত এই দলের সঙ্গে শুরু থেকে থাকা এক জন। তার মতে, এই দল ব্যর্থতার পেছনে প্রধান কারণ ক্যাবরেরার অযাচিত হস্তক্ষেপ। তিনি স্পেন, ঢাকা এমনকি নেপাল থেকেও এই দলের নির্দেশনা দিয়েছেন। সশরীরে মাঠে থেকেও অনুশীলনে কিছু গলদ থেকে যায় সেখানে এত দূর থেকে নির্দেশনা ও বাস্তবায়নে অনেক কিছুই অস্পষ্টতা থাকে। সেটার ফলশ্রুতিতেই এই ব্যর্থতা।
হাসান আল মামুন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক। এক সময়কার তারকা ফুটবলার। শেখ জামাল ধানমন্ডিতে শফিকুল ইসলাম মানিকের সহকারী হিসেবে মামুনের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। এরপর সেভাবে আর কোনো ক্লাবের হয়ে কাজ করেননি। ফেডারেশনে যোগদানের পর এক পর্যায়ে জাতীয় দলে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করছেন। বিশেষত স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার অত্যন্ত আস্থাভাজন তিনি। ক্লাব পর্যায়ে হেড কোচের দায়িত্ব পালন না করায় নানা প্রেক্ষাপটে অ-২৩ দল সরাসরি পরিচালনা করা মামুনের জন্য বেশ কঠিনই ছিল। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ও ফলাফলই এটার প্রমাণ। ফেডারেশন নীতি-নির্ধারকরা এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করেনি সেভাবে।
সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও কোচ জুলফিকার মাহমুদ মিন্টু অ-২৩ দলের ব্যর্থতার জন্য ফুটবলীয় সিস্টেমকে দায়ী করেছেন, ‘আমাদের সিস্টেমেই গলদ রয়েছে। সিস্টেম পরিবর্তন না হলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্য আসবে না। শুধু সার্টিফিকেট ভিত্তিক কোচ নয়, সুশিক্ষিত কোচ তৈরি করতে হবে। সেই কোচরাই স্বশিক্ষিত ফুটবলার বানাবে। পাশাপাশি ক্লাব-ফেডারেশন সংস্কৃতি-কাঠামোতে পরিবর্তন আসলে ইতিবাচক ও টেকসই ফলাফল প্রত্যাশা করা যায়।’
এমকে/এসএন