একে একে টানা চার মেয়াদে সরকারপ্রধান হন শেখ হাসিনা। কিন্তু গদিতে বসেই হস্তক্ষেপ করতে থাকেন সব অঙ্গনে। দলীয়করণ করা হয় পুলিশ-প্রশাসনসহ বিভিন্ন বাহিনীকে। এমনকি বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনকেও নিজের অনুকূলে রাখা হয়। এভাবেই ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন তৎকালীন এই প্রধানমন্ত্রী। তবে শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর লোকেরও কমতি ছিল না। আর সেসব সহযোগীর নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার মামলায় ৪৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
জবানবন্দিতে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে জঙ্গি দমনসহ মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন শেখ হাসিনা। তার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী রয়েছে। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ডিজিএফআই। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
বিচার বিভাগ থেকে ফ্যাসিবাদকে শক্তি যুগিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, আগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ও মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া পুলিশ বাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছেন সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ। আর সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান, হাবিবুর রহমান, ডিবির প্রধান হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার প্রমুখ। নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ছাড়া অন্যান্য কমিশনার এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছেন জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। ১৪ দলীয় নেতাদের মধ্যে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারি, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার ও তাদের সঙ্গীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, শমশের মুবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিজবাউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দীকি, মাহি বি চৌধুরীরাও ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী ও ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভুয়া নির্বাচনকালীন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় নিজেদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না সাবেক তিন সেনাপ্রধান তথা জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ ও জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ। ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে গুমসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস, হামিদুল হক। তবে র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত। তিনি জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের বাইরে থেকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল ভারতের।
জবানবন্দিতে আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো চিত্র তুলে ধরেন মাহমুদুর রহমান। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উঠে এসেছে তার সাক্ষ্যে। এদিন বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে। তবে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর সহিদুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।
এদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আর দু-একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়েই কার্যক্রম শেষ করবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এমকে/এসএন