বাংলাদেশের উঠতি তারকা পেসার তানজিম হাসান সাকিবের জন্মদিন আজ। বয়স মাত্র ২৩, কিন্তু ইতিমধ্যেই তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ ফাস্ট বোলিংয়ের অন্যতম আশার প্রতীক হিসেবে। ক্রিকেটের প্রতিটি বলের পেছনে লুকিয়ে থাকে পরিশ্রম, সাহস আর আত্মবিশ্বাস-আর সেই গল্পেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি এই তরুণ।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম সাকিবের। বাবা গাউচ আলী ও মা সেলিনা বেগম, দুজনেই চেয়েছিলেন ছেলে যেন পড়াশোনা করে কিছু হয়। কিন্তু সাকিবের মন টানত অন্যদিকে। ছোটবেলা থেকেই ব্যাট-বলেই খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের আনন্দ। স্কুল শেষে পাড়ার মাঠে ছেলেদের সঙ্গে বল করে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
স্থানীয় টুর্নামেন্টেই প্রথম নজরে আসেন কোচদের। ১৪–১৫ বছর বয়সেই বোঝা যায়, এই ছেলেটার হাতে গতি আছে, বল সুইং করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা জেতার তীব্র ইচ্ছে আছে। এরপরই শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেটে তার যাত্রা।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ দলে সুযোগ পাওয়া ছিল তার ক্রিকেটজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অধ্যায়। ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিশ্বজয়ী দলের অংশ। সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে উল্লাসে যেভাবে চোখ ভিজেছিল লাখো ক্রিকেটপ্রেমীর, সাকিবও ছিলেন সেই আনন্দের অংশীদার।
তারপর শুরু হয় ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত লড়াই। একের পর এক পারফরম্যান্সে তিনি প্রমাণ করেন, শুধু বয়সভিত্তিক ক্রিকেট নয়, জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়ার মতো সামর্থ্য তার আছে।
অবশেষে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের বিপক্ষে ওডিআই অভিষেক আর সেই ম্যাচেই জ্বলে ওঠেন তিনি। প্রথম ওভারেই রোহিত শর্মাকে কাঁপিয়ে দেন তীক্ষ্ণ ইনসুইংয়ে। দর্শকের চোখে নতুন এক পেসারের আগমন ধরা দেয় সেদিনই।
তানজিম সাকিব মূলত ডানহাতি মিডিয়াম-ফাস্ট বোলার। তার সবচেয়ে বড় শক্তি বলের দিক বদলানোর দক্ষতা। নতুন বলে ইনসুইং-আউটসুইং দুটোই করতে পারেন আর পুরোনো বলে ব্যাটারদের ফাঁদে ফেলতে জানেন।
তার রানআপে আছে আত্মবিশ্বাসের ছাপ, ডেলিভারির পরের প্রতিটি চিৎকারে দেখা যায় এক যোদ্ধার রূপ। কোচরা বলেন, সাকিবের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সংখ্যায় মাপা যায় না সেটা হলো খেলার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।
ব্যাটিংয়েও তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে উন্নত করছেন। নিচের ক্রমে নেমে দলকে রক্ষা করার কিছু মুহূর্ত তার ক্যারিয়ারে ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে।
তবে পথচলা একদম মসৃণ ছিল না। ২০২৩ সালের শেষদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন তিনি। তখন কেউ কেউ ভেবেছিল, হয়তো তরুণ এই পেসার হারিয়ে যাবেন আলোচনার ভেতরেই। কিন্তু না, তিনি ফিরেছিলেন আরও দৃঢ়ভাবে, আরও মনোযোগী হয়ে। মাঠে পারফরম্যান্স দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, তিনি মূলত ক্রিকেটার-যার সব উত্তর পাওয়া যায় বলের গতিতে, উইকেটের পতনে।
এই কঠিন সময়ই তাকে শিখিয়েছে কীভাবে জনপ্রিয়তার ভার সামলাতে হয়, কীভাবে সমালোচনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয়।
২০২৪ সালে টি২০ বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স নজর কাড়ে। বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটে তার সংযোজন এনে দেয় নতুন ভারসাম্য। প্রতিটি স্পেলে দেখা গেছে আগ্রাসন ও আত্মবিশ্বাসের মিশ্রণ। তিনি শুধু উইকেট শিকার করেননি, বরং দলের মনোবলও বাড়িয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবসময়ই মানসম্পন্ন পেসারের অভাব ছিল। এখন তাসকিন, শরিফুল, এবাদতদের সঙ্গে তানজিমের নাম যুক্ত হয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করছে। তার বয়স কম, অভিজ্ঞতা সীমিত, কিন্তু সামর্থ্য অশেষ। নিয়মিত সুযোগ, সঠিক প্রশিক্ষণ ও মনোযোগ ধরে রাখতে পারলে তিনি আগামী এক দশকে বাংলাদেশের বোলিং লিডার হয়ে উঠতে পারেন।
মাঠে আগ্রাসী হলেও, মাঠের বাইরে সাকিব একদম সহজ-সরল। গ্রামের প্রতি টান এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই ফিরে যান সিলেটের বাড়িতে। গ্রামের মাঠে ছোট ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেন, মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটান।
বন্ধুদের কাছে তিনি ‘সাকিব ভাই’ নয়, বরং ‘সাকিব দা’ যিনি কখনো অহংকার দেখান না, বরং সবাইকে সাহস জোগান। আজ তার জন্মদিনে ক্রিকেটপ্রেমীরা প্রত্যাশা করছেন-এই তরুণ যেন আরও বড় হয়ে ওঠেন, আরও ধারালো হন, আরও অনেক দিন দেশের জার্সিতে গর্বের সঙ্গে খেলেন।
এবি/টিকে