আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিত করার দাবিতে ১২ দফা নাগরিক ইশতেহার প্রকাশ করেছেন দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই ইশতেহার তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ইশতেহার পাঠ করেন ক্লিন-এর নেটওয়ার্ক অ্যাডভাইজার মনোয়ার মোস্তফা। তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎ পৌঁছেছে প্রায় ৯৯.২৫ শতাংশ পরিবারে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অযৌক্তিক জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা ও অস্বচ্ছ চুক্তির কারণে আর্থিক ক্ষতি, পরিবেশগত অবনতি এবং জনস্বাস্থ্যের গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, দেশের কার্বন নির্গমন ২০০৮ সালের ১৪৬.৮ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২৮১.৪ মিলিয়ন টন হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বায়ুর মান এখন বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বিডব্লিউজিইডি-এর সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, গত ১৬ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ১.৭২ ট্রিলিয়ন টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে ক্ষতি হয়েছে ২.৫৩ ট্রিলিয়ন টাকা, যার বোঝা কমাতে সরকারকে দিতে হয়েছে ২.৩৬ ট্রিলিয়ন টাকা ভর্তুকি।
ইশতেহারের ১২ দফায় যা বলা হয়েছে-
১) জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন : জলবায়ু, পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় সমন্বিত জাতীয় জ্বালানি নীতি তৈরি এবং নীতিনির্ধারণে নাগরিক সমাজ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে।
২) জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত : সব বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) ও বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) জনসমক্ষে উন্মুক্ত করা এবং দুর্নীতি ও পাচার ঠেকাতে কার্যকর জবাবদিহিতা গঠন করা।
৩) জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি কমানো : কয়লা–গ্যাস–তেলের ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে শিল্প ও ব্যবসায়িক খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং সহজ ঋণ–কর রেয়াত প্রদান করা।
৪) নতুন জীবাশ্মবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ : কয়লা–গ্যাস–তেলভিত্তিক নতুন প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া, অকার্যকর কেন্দ্র বন্ধ করা এবং ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল ও শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
৫) নতুন এলএনজি প্রকল্প নয় : নতুন এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ, অকার্যকর গ্যাসকেন্দ্র বাদ দিয়ে সার ও শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো এবং সব খাতে মিটারিং বাধ্যতামূলক করা।
৬) নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা বাধ্যতামূলক : ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা; বাজেটের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য খাতে বরাদ্দ ও উপকরণে শুল্ক–ভ্যাট শূন্য করা।
৭) পরিবহন খাত সবুজায়ন : ইলেকট্রিক যানবাহনের শুল্ক প্রচলিত যানবাহনের তুলনায় কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ কমানো এবং উন্নতমানের ব্যাটারির আমদানি কর শূন্যে নামানো।
৮) স্মার্ট গ্রিড ও পরিবারের সৌরবিদ্যুৎ : গ্রিড আধুনিকায়ন, ‘সূর্যবাড়ি’ প্রকল্পে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি ও স্বল্পসুদে ৭০ শতাংশ ঋণ; নারী, আদিবাসী ও দরিদ্রদের জন্য অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সহায়তা করা।
৯) নবায়নযোগ্য খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থান : তরুণ–তরুণী, নারী, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণ দিয়ে ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
১০) অপ্রমাণিত ব্যয়বহুল প্রযুক্তি পরিহার : অ্যামোনিয়া, সিসিএস, তরল হাইড্রোজেন, পারমাণবিক ও বর্জ্য-বিদ্যুৎ প্রযুক্তি পরিহার; বর্জ্য হ্রাস, শ্রেণিবিন্যাস, পুনর্ব্যবহার ও জৈবসারভিত্তিক সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা।
১১) জ্বালানি পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও অধিকার : নারী–আদিবাসী–কৃষক–জেলে–দরিদ্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; স্থানীয় জনগণকে জ্বালানি অবকাঠামোর মুনাফায় অংশীদার করা।
১২) কৃষিজমি অধিগ্রহণ বন্ধ : বিদ্যুৎ–জ্বালানি প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ করা; দীর্ঘমেয়াদি ইজারা পদ্ধতি চালু এবং কৃষিবিদ্যুৎ ও ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
নাগরিক সমাজ আশা প্রকাশ করে বলেছে— আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সবুজ রূপান্তর, সাশ্রয়ী জ্বালানি নিশ্চিতকরণ এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করবে। কারণ, ন্যায্য শক্তি রূপান্তরই দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ওয়াসিউর রহমান এবং লিড বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক শিমনউজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডাব্লিউজিইডি)। সহ-আয়োজক হিসেবে ছিলো— বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর লেবার স্টাডিজ (বিলস্), উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন), এথিক্যাল ট্রেড ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই বাংলাদেশ), লইয়ার্স ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (লিড), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং রিগ্লোবাল।
টিজে/টিকে