বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী দেশগুলোর স্পর্শকাতর ও কৌশলগত খাতে সরাসরি চীনা রাষ্ট্র-সমর্থিত বিনিয়োগের ব্যাপক প্রবাহ গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। ভার্জিনিয়া-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডডাটা (AidData)-এর একটি নতুন এক্সক্লুসিভ ডেটা সেট এই বিনিয়োগের এক অবিশ্বাস্য চিত্র তুলে ধরেছে। এতে দেখানো হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে বেইজিং চীনের বাইরে ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যার প্রায় অর্ধেকই গিয়েছে ধনী পশ্চিমা দেশগুলোতে।
পশ্চিমা সরকারগুলোর নজর এড়িয়ে যাওয়া এই বিপুল বিনিয়োগ যে কেবল বাণিজ্যিক লাভের জন্য নয়, বরং কৌশলগত আধিপত্যের অংশ—তা এখন স্পষ্ট। এর ফলস্বরূপ, সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে টেলিযোগাযোগ—বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনা বিনিয়োগ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র তার আইন কঠোর করতে বাধ্য হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন তার বিনিয়োগ স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া (সিএফআইইউএস) কঠোর করল, তার একটি প্রধান দৃষ্টান্ত হলো রাইট ইউএসএ (Wright USA) নামক একটি বিমা কোম্পানির বিক্রি হয়ে যাওয়া। এই কোম্পানিটি এফবিআই (এফবিআই) এবং সিআইএ (সিআইএ) এজেন্টসহ মার্কিন গোয়েন্দা কর্মীদের দায়বদ্ধতা বিমা সরবরাহ করত।
চীনের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ফোসুন গ্রুপ (Fosun Group), সি চিনপিং সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, ২০১৫ সালে তারা নীরবে এই মার্কিন স্পর্শকাতর বিমা কোম্পানিটি কিনে নেয়। এই ক্রয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল স্পষ্ট, কারণ কোম্পানির কাছে থাকা অসংখ্য শীর্ষ গোয়েন্দা পরিষেবা এজেন্ট এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য এখন চীনের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে।
গোয়েন্দা বিষয়ক প্রবীণ সাংবাদিক জেফ স্টাইন এই ঘটনাটি ফাঁস করেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, লেনদেনটি আইনত বৈধ হলেও, চীনের শাসনব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ আন্তঃসংযোগের কারণে এই তথ্য কার্যত চীনা গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এইডডাটা সম্পর্কিত একটি নতুন তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, এতে দেখা গেছে, এই অধিগ্রহণে চীন সরকারও জড়িত ছিল। চারটি চীনা রাষ্ট্র-পরিচালিত ব্যাংক কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের মাধ্যমে ফোসুনকে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল।
স্টাইনের রিপোর্ট প্রকাশের পর ওয়াশিংটনে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যার ফলে সিএফআইইউএস তদন্ত শুরু করে এবং এর অল্প সময়ের মধ্যেই কোম্পানিটিকে আবার আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করে, রাইট ইউএসএ বিক্রির ঘটনাই ছিল ২০১৮ সালে প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনকে বিনিয়োগ আইন কঠোর করতে উৎসাহিত করার অন্যতম প্রধান কারণ।
এইডডাটা-এর নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড পার্কস স্বীকার করেন, বহু বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলো ধরে নিয়েছিল যে চীনের অর্থপ্রবাহ প্রধানত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যাচ্ছে। তাই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির মতো জায়গায় শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চলছিল, এগুলো ছিল তাদের নজরের বাইরে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি চায়না সেন্টারের পরিচালক ভিজিটর শিহ চীনের আর্থিক ব্যবস্থার অভূতপূর্ব ক্ষমতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, চীনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশ্বের বৃহত্তম—যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানকে একত্রিত করলেও যা হবে, তার চেয়েও বড়।
বেইজিং এই বিশাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করে ঋণের গন্তব্য নির্ধারণ করে।
বিনিয়োগের কিছু অংশ নিছক মুনাফা অর্জনের জন্য হলেও, বেশিরভাগই বেইজিং-এর কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য নির্ধারিত। এর মূল চালিকাশক্তি হলো এক দশক আগে ঘোষিত ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ উদ্যোগ। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য রোবোটিক্স, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সেমিকন্ডাক্টর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো ১০টি অত্যাধুনিক শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করা এবং বিদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে মূল প্রযুক্তিগুলো চীনে আনা। যদিও বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণে প্রকাশ্যে এই পরিকল্পনার উল্লেখ কমিয়ে দিয়েছে চীন, তবে ভিজিটর শিহ নিশ্চিত করেছেন, এটি কৌশলগতভাবে এখনও সচল রয়েছে।
ইউরোপেও এই ধরনের বিনিয়োগের কৌশলগত ফল দেখা দিয়েছে। নেদারল্যান্ডসে চীনা মালিকানাধীন সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি নেক্সপেরিয়া (Nexperia)-কে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটিকে অধিগ্রহণ করতে চীনা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল।
নেক্সপেরিয়ার কৌশলগত মূল্য এতই বেশি ছিল যে, ডাচ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কোম্পানির কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের মূল উদ্বেগ ছিল, নেক্সপেরিয়ার স্পর্শকাতর প্রযুক্তি চীনা মূল কোম্পানি উইংটেক (Wingtech)-এর অন্যান্য অংশে স্থানান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি। এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপে কোম্পানিটিকে কার্যকরভাবে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে—ডাচ অপারেশনস এবং চীনা ম্যানুফ্যাকচার। কারণ নেক্সপেরিয়া স্বীকার করেছে, তাদের চীনা ব্যবসাটি উইংটেকের কাঠামো অনুযায়ী কাজ করে। এমনকি নির্দেশনা উপেক্ষা করার কথাও তারা স্বীকার করেছে।
দ্য হেগের ক্লিঙ্গেন্ডেল ইনস্টিটিউটের গবেষক জিয়াওক্সু মার্টিন বলেন, মুক্ত বাণিজ্যে অভ্যস্ত ডাচদের জন্য সরকারের এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ বিস্ময়কর। এটি প্রমাণ করে, ভূ-রাজনীতি এখন বিনিয়োগে নজরদারির মতো শিল্পনীতি গ্রহণকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
চীন এই বিনিয়োগ কৌশলকে সবসময়ই স্থানীয় আইন মেনে চলা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক বলে দাবি করে। চীনা কোম্পানিগুলো বিশ্বজুড়ে স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখে, এমনটাই দাবি বেইজিংয়ের কূটনীতিকদের।
তবে, পশ্চিমা সরকারগুলো এই বিনিয়োগকে এখন বেইজিং-এর বৃহত্তর কৌশল হিসাবে দেখছে। ব্র্যাড পার্কস মনে করেন, স্পর্শকাতর খাতে চীনা বিনিয়োগের পরিকল্পনায় চীন এখন ‘গতিপ্রকৃতি নির্ধারক’। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘আমার ধারণা, অনেক জি-৭ দেশ এখন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক অবস্থান-এ আসবে। তারা শুধু প্রতিরক্ষা নয়, কৌশলগত পাল্টা পদক্ষেপের দিকে যাবে।’
এই বিনিয়োগগুলো আইনত বৈধ হলেও, শেল কোম্পানি এবং অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এগুলোর শিকড় প্রায়শই অস্পষ্ট থাকে। এই কৌশলগত অস্পষ্টতা দূর করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্য প্রধান অর্থনীতিগুলো তাদের বিনিয়োগ যাচাই প্রক্রিয়াকে আরও তীক্ষ্ণ ও কঠোর করছে। আগামী দশকে বিশ্ব অর্থনীতি ও প্রযুক্তির আধিপত্যের লড়াইয়ে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে চলেছে পশ্চিমাদের এই নতুন নীতি।
আইকে/টিএ