মায়ানমারে আগামী রবিবার সাধারণ নির্বাচনের প্রথম ধাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। পাঁচ বছরের মধ্যে এটিই দেশটির প্রথম ভোট। তবে সমালোচকদের মতে, এই নির্বাচন ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে না, কিংবা কঠোর সামরিক শাসনের ফলে শুরু হওয়া ভয়াবহ গৃহযুদ্ধেরও অবসান ঘটাবে না।
মায়ানমারের সামরিক সরকার এই নির্বাচনকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী নিজেদের শাসনকে বৈধতার একটি আবরণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। চার বছর আগে সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারপ্রধান অং সান সু চিকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে ব্যাপক গণবিরোধিতা শুরু হয়, যা পরে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। চলমান সংঘাতের কারণে বহু বিতর্কিত ও সংঘর্ষপূর্ণ এলাকায় নির্বাচন আয়োজন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
নির্বাচনটি তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপ রবিবার, দ্বিতীয় ধাপ, ১১ জানুয়ারি এবং তৃতীয় ধাপ, ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী দলগুলো বলছে, এই নির্বাচন স্বাধীন ও সুষ্ঠু হবে না এবং প্রকৃত ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত সামরিক প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের হাতেই থেকে যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মায়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সি বলেন, এই নির্বাচন পরিচালনা করছে সেই একই সেনাবাহিনী, যারা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল।
তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, ‘এই নির্বাচন একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। গত ও তার আগের নির্বাচনে যারা ভালো ফল করেছিল, তাদের কোনো রাজনৈতিক দলই এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।’
হর্সির মতে, সেনাবাহিনীর কৌশল হলো তাদের পছন্দের দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (ইউএসডিপি) বিপুল জয় এনে দেওয়া। এর মাধ্যমে সরাসরি সামরিক শাসন থেকে সরে একটি ‘নাগরিক মুখোশধারী’ সরকার গঠন করা হবে, যা বাস্তবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণই বজায় রাখবে।
এতে করে সামরিক সরকার দাবি করতে পারবে যে, নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি আসিয়ানভুক্ত ১১ দেশের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে তারা দেখাতে চাইছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোও মায়ানমারের সামরিক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখার যুক্তি পাবে, যাকে তারা ‘স্থিতিশীলতা রক্ষা’ হিসেবে তুলে ধরে। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো মায়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। কারণ হিসেবে তারা গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছে।
রবিবার মায়ানমারের ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে ১০২টিতে ভোটগ্রহণ হবে। ১১ ও ২৫ জানুয়ারিতে পরবর্তী ধাপগুলো অনুষ্ঠিত হবে। তবে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে চলমান সংঘাতের কারণে ৬৫টি টাউনশিপে কোনো ভোটই হবে না। মোট ৫৭টি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিয়েছে।
তবে অধিকাংশ দলই কেবল নিজ নিজ রাজ্য বা অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মাত্র ছয়টি দল সারা দেশে নির্বাচন করছে, যাদের পক্ষে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবু নির্বাচনী নিয়ম এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউএসডিপি নতুন সরকার গঠনে এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতীয় সংসদের দুই কক্ষ এবং রাজ্য ও আঞ্চলিক আইনসভায় ১ হাজার ১০০টির বেশি আসনের জন্য প্রায় ৫ হাজারের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে যেখানে ভোট হচ্ছে না, সেখানে আসনগুলো খালি থাকবে। ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন এখনো যোগ্য ভোটারের মোট সংখ্যা জানায়নি। তবে ২০২০ সালে দেশটিতে ভোটার ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখের বেশি।
মায়ানমারের ৮০ বছর বয়সী সাবেক নেত্রী অং সান সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। সু চি বর্তমানে ২৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এসব অভিযোগকে আন্তর্জাতিকভাবে ভুয়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা হয়। সামরিক সরকারের নতুন নিয়মে নিবন্ধন করতে অস্বীকার করায় এনএলডি দলটিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য অনেক দলও নির্বাচন বর্জন করেছে বা অন্যায় পরিবেশের কারণে প্রার্থী দেয়নি। বিরোধী গোষ্ঠীগুলো ভোটারদেরও নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে।
এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনের বিশ্লেষক আমায়েল ভিয়ের বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে যেসব দল ৯০ শতাংশ আসন জিতেছিল, সেগুলোর অধিকাংশই এখন আর অস্তিত্বই নেই। চলতি বছর প্রণীত ইলেকশন প্রোটেকশন আইন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এই আইনে নির্বাচনের সমালোচনা কার্যত নিষিদ্ধ।
গত কয়েক মাসে লিফলেট বিতরণ বা অনলাইন পোস্টের জন্য ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব পরিস্থিতি মিলিয়ে সামরিক-সমর্থিত ইউএসডিপির একচেটিয়া আধিপত্য এবং ৬৯ বছর বয়সী মিন অং হ্লাইং-এর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথই তৈরি হচ্ছে।
মায়ানমারের সংঘাতের মানবিক মূল্য ভয়াবহ। রাজনৈতিক বন্দিদের সহায়তায় কাজ করা সংগঠন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, বর্তমানে ২২ হাজারের বেশি মানুষ রাজনৈতিক কারণে আটক রয়েছেন। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৭ হাজার ৬০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া যুদ্ধের কারণে ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা ৩৬ লাখেরও বেশি, যা একটি গুরুতর মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলেছে, ‘সামরিক নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের আগে মায়ানমারের সহিংসতা, দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতি আরো তীব্র হয়েছে।’ তারা জানায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বেসামরিক নাগরিকরা সেনা কর্তৃপক্ষ ও সশস্ত্র বিরোধী উভয় পক্ষের কাছ থেকেই হুমকির মুখে পড়ছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক জো ফ্রিম্যান বলেন, অনেকের আশঙ্কা এই নির্বাচন বছরের পর বছর ধরে অবৈধ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষমতাকেই আরো পাকাপোক্ত করবে। রিচার্ড হর্সির মতে, ভোটের পর মায়ানমারের সংঘাত আরো বাড়তে পারে।
সূত্র : আরব নিউজ