ইতালির আবরুজো অঞ্চলের মাউন্ট গিরিফালকোর ঢালে অবস্থিত ক্ষুদ্র গ্রাম পাগলিয়ারা দেই মার্সি আজ যেন মানুষের চেয়ে বিড়ালের রাজ্য। সরু অলিগলিতে বিড়ালদের অবাধ বিচরণ, মানুষের ঘরে অনায়াস যাতায়াত আর পাহাড়মুখী পাঁচিলে আরাম করে শুয়ে থাকার দৃশ্যই এখানে নিত্যদিনের চিত্র। দীর্ঘদিন ধরে জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় গ্রামটি কার্যত নীরবতায় আচ্ছন্ন, যেখানে বিড়ালদের গরগর শব্দই প্রাণের উপস্থিতি জানান দেয়।
এই নীরবতা ভাঙতে শুরু করে চলতি বছরের মার্চে, যখন গ্রামটিতে জন্ম নেয় একটি শিশু। প্রায় তিন দশক পর জন্ম নেয়া এই শিশুর নাম লারা বুসি ট্রাবুক্কো। তার আগমনে গ্রামটির জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ জনে।এত ছোট একটি জনপদের জন্য এটি শুধু আনন্দের খবর নয়, বরং এক বিরল ঐতিহাসিক ঘটনা।
লারার জন্মের পরপরই গ্রামের ঠিক বিপরীতের গির্জায় অনুষ্ঠিত হয় খ্রিস্টান ধর্মীয় দীক্ষা অনুষ্ঠান। সেই আয়োজনে গ্রামবাসীদের পাশাপাশি যেন নীরব সাক্ষী ছিল বিড়ালগুলোর দলও। গ্রামটিতে শিশু থাকা যেখানে একেবারেই অস্বাভাবিক, সেখানে লারা এখন গ্রামের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে শুধু এই শিশুটিকে এক নজর দেখার জন্য।
লারার মা সিনজিয়া ট্রাবুক্কো বলেন, আগে অনেকেই জানতেন না পাগলিয়ারা দেই মার্সি নামের কোনো জায়গা আছে। কিন্তু এখন তার মেয়ের কারণে গ্রামটি পরিচিতি পাচ্ছে। মাত্র নয় মাস বয়সেই লারা যেন গ্রামটির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এই এক শিশুর জন্ম যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি তা ইতালির গভীর জনসংখ্যা সংকটের দিকটিও সামনে আনছে। দেশটির পরিসংখ্যান সংস্থা ইস্ট্যাট জানিয়েছে, টানা ১৬ বছর ধরে জন্মহার কমতে কমতে ২০২৪ সালে তা ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমেছে। ওই বছর দেশজুড়ে জন্ম নেয় মাত্র ৩ লাখ ৬৯ হাজারের কিছু বেশি শিশু। প্রজনন হার নেমে এসেছে গড়ে ১.১৮-এ, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অন্যতম নিচু হার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকটের পেছনে রয়েছে চাকরির অনিশ্চয়তা, তরুণদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা, কর্মজীবী মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তার অভাব এবং স্বেচ্ছায় সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত। ইস্ট্যাটের ২০২৫ সালের প্রাথমিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই ধারা আরও অবনতির দিকে। ইতালির ২০টি অঞ্চলের মধ্যে আবরুজোতেই পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ, যেখানে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে জন্মহার আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি কমেছে।
এই বাস্তবতায় পাগলিয়ারা দেই মার্সি যেন পুরো দেশের এক ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। এখানে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অথচ নতুন প্রজন্ম প্রায় নেই বললেই চলে। স্থানীয় মেয়র জিউসেপিনা পেরোজ্জি জানান, গ্রামে একের পর এক বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হলেও তাদের জায়গা নেওয়ার মতো কোনো তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
লারার বাবা-মা সরকারি ‘বেবি বোনাস’ ও মাসিক ভাতা পেলেও তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কাজের পাশাপাশি সন্তানের যত্ন। ইতালিতে দীর্ঘদিন ধরেই চাইল্ডকেয়ার ব্যবস্থা দুর্বল। ফলে অনেক নারী মাতৃত্বের পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ট্রাবুক্কোর মতে, শুধু আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে এই সংকট কাটানো যাবে না; প্রয়োজন পুরো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার।
সূত্র: গার্ডিয়ান
এসকে/এসএন