‘যুদ্ধ’ থামতেই পাকিস্তানকে চাপে রাখতে নয়া কৌশল। ফের ‘আফগান-তাস’ খেলল নয়াদিল্লি। কাবুলের তালিবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে এ বার সরাসরি কথা বললেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। দ্বিতীয় তালিবানি শাসনে দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে এটাই প্রথম কথোপকথন। আগামী দিনে হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অন্য খাতে বইবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
গত ১০ মে বিকেল ৫টা নাগাদ আনুষ্ঠানিক ভাবে সংঘর্ষবিরতি চালু করে ভারত ও পাকিস্তান। এর ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় (পড়ুন ১৫ মে) তালিবানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমিরকে ফোন করেন জয়শঙ্কর। কথোপকথন শেষে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট দেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। সেখানে পহেলগাঁও হামলার নিন্দা করা নিয়ে তালিবান সরকারকে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানান তিনি। উল্লেখ করেছেন আফগানদের সঙ্গে এ দেশের ‘ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বের’।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের এই মনোভাবই নয়াদিল্লি ও কাবুলের সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। শুধু তা-ই নয়, আমু দরিয়ার তীরের শাসকগোষ্ঠীর গায়ে এখনও সেঁটে রয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীর তকমা। এ বার তা ধীরে ধীরে সরিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে সাউথ ব্লক।
দুই বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে কথোপকথন নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেন তালিবানের ‘ডিরেক্টর অফ কমিউনিকেশন’ হাফিজ জ়িয়া আহমেদ। তাঁর দাবি, চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চাওয়া আফগানদের আরও বেশি করে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন মুত্তাকি। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, আফগান বন্দি মুক্তি ও প্রত্যর্পণ এবং ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন এবং ব্যবহারের বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে কথা হয়েছে।
জয়শঙ্কর-মুত্তাকির ফোনালাপ শেষ হতেই পুশতু ভাষায় একের পর এক পোস্ট করেন হাফিজ জ়িয়া। তাঁর লেখায় বার বার এসেছে চাবাহার বন্দরের কথা। ভারতের সঙ্গে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের বাণিজ্য পুরোপুরি ছিল পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ। ফলে প্রতিবেশী দেশটির মধ্যে দিয়ে আর পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবেন না আফগান ব্যাপারীরা।
এই পরিস্থিতিতে একমাত্র ইরানের চাবাহারই কাবুলের তালিবান শাসকদের ভরসা। পারস্য উপসাগরের তীরের ওই বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। সড়কপথে চাবাহারে পণ্য নিয়ে এসে সামুদ্রিক রাস্তায় তা পশ্চিম ভারতের মুম্বই বা গুজরাতের কোনও বন্দরে নিয়ে যেতে চাইছেন আফগান ব্যবসায়ীরা। নয়াদিল্লি অচিরেই এই অনুমতি তাঁদের দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে স্থলপথে সরাসরি বাণিজ্যের বহু প্রাচীন একটি রাস্তা রয়েছে। সরু একফালি ওই জায়গার নাম ওয়াখান বারান্দা (পড়ুন ওয়াখান করিডর)। কিন্তু, এলাকাটি পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেটি ব্যবহার করতে পারে না নয়াদিল্লি। কৌশলগত দিক থেকে ওয়াখান বারান্দার গুরুত্ব অপরিসীম। ওই পথে মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে নয়াদিল্লি, মুম্বই এবং হায়দরাবাদে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে কনস্যুলার পরিষেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। ফলে ব্যবসা, উচ্চশিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা আফগান নাগরিকেরা বেশ কিছু প্রশাসনিক সুবিধা পাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যে ভাবে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে, তাতে অচিরেই দিল্লিতে দূতাবাস খোলার অনুমতি পাবে তালিবান প্রশাসন।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সংঘাত চরমে পৌঁছোয়। ৭ মে মধ্যরাতে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের মোট ন’টি জায়গায় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’।
কিন্তু, মোদী সরকার এই পদক্ষেপ নিতেই পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তায় হাঁটে ইসলামাবাদ। তড়িঘড়ি ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান নিয়ে আক্রমণ শানাতে গেলে ফল হয় হিতে বিপরীত। ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যবহার করে সেগুলিকে শূন্যেই ধ্বংস করে ভারতীয় সেনা। পাশাপাশি, ফের হামলা চালিয়ে পাক বিমানবাহিনীর ১১টি ছাউনি প্রায় ধ্বংস করে দেয় এ দেশের বায়ুসেনা।
ভারত-পাক এই সংঘর্ষ পর্বে তালিবানের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই পহেলগাঁও হামলার নিন্দা করে বিবৃতি দেয় কাবুলের শাসকগোষ্ঠী। পরে ‘যুদ্ধ’ পর্বে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের অপপ্রচার চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয় তারা। এর জন্য বিশেষ করে মুত্তাকিকে ধন্যবান জানিয়েছেন জয়শঙ্কর। এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। সেটা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তালিবান সরকার।’’
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারের পর সেখানে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। তাঁদের সরকারি ভাবে স্বীকৃতি না দিলেও হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে মানবিক সাহায্য পাঠিয়ে গিয়েছে নয়াদিল্লি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত কয়েক বছরে ৫০ হাজার টনের বেশি গম, ৩০০ টনের বেশি ওষুধ এবং ২৭ টনের বেশি ভূমিকম্প-ত্রাণ পাঠিয়েছে মোদী সরকার।
এ ছাড়া দিল্লি থেকে আমু দরিয়ার তীরে গিয়েছে ৪০ হাজার লিটার কীটনাশক, ১০ কোটি পোলিও টিকা, ১৫ লক্ষ কোভিড টিকা, মাদকের নেশামুক্তির জন্য ১১ হাজার ইউনিট কিট, ৫০০ ইউনিট শীতকালীন পোশাক এবং ১.২ টন স্টেশনারি কিট। হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল ভারত। সেগুলি ফের মোদী সরকার চালু করুক, তা চাইছেন তালিবান নেতৃত্ব।
গত ২৭ এপ্রিল পহেলগাঁও হামলার ছ’দিনের মাথায় তালিবান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের বিশেষ প্রতিনিধি তথা যুগ্ম সচিব আনন্দ প্রকাশ। কাবুলে আফগানদের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মুত্তাকির সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর। বর্তমানে আফগানিস্তান, ইরান এবং পাকিস্তান ডেস্কের ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন আনন্দ প্রকাশ।
গত কয়েক বছর ধরেই আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে এক রকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। পাশতুনভাষী খাইবার-পাখতুনখোয়াকে নিয়ে স্বাধীন পাশতুনিস্তান তৈরির স্বপ্ন রয়েছে তাঁদের। অন্য দিকে কাশ্মীর ইস্যুতেও পাক ফৌজের পুরোপুরি উল্টো অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে টিটিপিকে।
ইসলামাবাদের শাহবাজ় শরিফ সরকারের অভিযোগ, টিটিপিকে আশ্রয়, হাতিয়ার এবং মদত দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান। কারণ, ‘ডুরান্ড লাইন’-এর আন্তর্জাতিক সীমান্ত বদল করতে চায় তাঁরা। যদিও পাকিস্তানের এই কথা মানতে নারাজ কাবুলের শাসকদল। উল্টে পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’ বলে বার বার উল্লেখ করে এসেছে তারা।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই সমস্ত কারণে ইসলামাবাদ এবং কাবুলের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল দিন দিন চওড়া হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে ‘এয়ার স্ট্রাইক’ চালায় পাক বিমানবাহিনী। এতে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাইছে ভারত।
ইতিমধ্যেই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে চিন। আফগানিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়াও। গত দু’টি কেন্দ্রীয় বাজেটে কাবুলের শাসকদের হাতে উন্নয়নের স্বার্থে মোটা অর্থ তুলে দেয় মোদী সরকার। ফলে ‘ছুতমার্গ’ কাটিয়ে নয়াদিল্লি তালিবানকে পুরোপুরি মেনে নিলে বিপদ বাড়বে পাকিস্তানের। তখন সরাসরি ভারতের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসাও করতে পারবে আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।
এসএন