ভারতে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা চালুর আরও কাছে পৌঁছে গেল স্টারলিংক। দেশটির টেলিকম মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ একটি লাইসেন্স পেয়েছে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান। বিষয় সম্পর্কে অবগত দুটি সূত্রের উল্লেখ করে আজ (শুক্রবার) বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
রয়টার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালুর আনুষ্ঠানিক অনুমতি লাভ করল স্টারলিংক। এবার নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন মেনে সেবা চালু প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্সের এই সহযোগী প্রতিষ্ঠানটিকে (সাবসিডিয়ারি)।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে মাস্কের চলমান দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যের আসার প্রেক্ষাপটে স্পেসএক্সের ২২ বিলিয়ন ডলারের সরকারি চুক্তি যখন হুমকির মুখে তখন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা চালুর লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়টি কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দেবে ইলন মাস্ককে।
উল্লেখ্য, এপ্রিলে বাংলাদেশেও ইন্টারনেট সেবা চালুর আনুষ্ঠানিক অনুমতি পায় স্টারলিংক। গত ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর কাছ থেকে নন-জিওস্টেশনারি অরবিট বা এনজিএসও লাইসেন্স গ্রহণ করে স্টারলিংক। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুমোদন সাপেক্ষে এই লাইসেন্স প্রদান করা হয় প্রতিষ্ঠানটি।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা চালুর অনুমতি প্রাপ্ত প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় স্টারলিংক।
তবে ভারতে টেলিকম মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স পাওয়া তৃতীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্টারলিংক। দেশটিতে এর আগে আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউটেলস্যাট-এর ওয়ানওয়েব এবং রিলায়েন্স জিও-কে ঠিক একই লাইসেন্স প্রদান করেছে ভারতের টেলিযোগাযোগ বিভাগ। অর্থাৎ, ভারতে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট চালুর অনুমতি আছে এখন ৩টি প্রতিষ্ঠানের।
তবে সাম্প্রতিকেই লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়ে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি স্টারলিংক। এমনকি ভারতের টেলিযোগাযোগ বিভাগের তরফ থেকেও এ সম্পর্কিত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও আসেনি।
ভারতের বাজারে ২০২২ সাল থেকেই লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইলন মাস্কের স্টারলিংক। তাদের লাইসেন্স প্রাপ্তির পথে মূল বাধা ছিল দেশটিতে বিদ্যমান জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত শর্তাবলী। তবে চলতি বছরের শুরুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা সফরে গেলে মাস্ক ও মোদির মধ্যকার আলোচনায় উঠে আসে ভারতে স্টারলিংকের লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়টি। এরপর থেকেই স্টারলিংককে অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
তবে টেলিকম মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই লাইসেন্স প্রাপ্তির মানে এই নয় যে, স্টারলিংক কাল থেকেই ইন্টারনেট সেবা চালু করতে পারবে ভারতে। এজন্য আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা এখনও বাকি আছে। তৃতীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা চালু করতে হলে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো’র কাছ থেকেও লাইসেন্স নিতে হবে স্টারলিংককে, যার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
পাশাপাশি স্টারলিংককে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এও প্রমাণ করতে হবে যে, তারা দেশটিতে বিদ্যমান নিরাপত্তা সম্পর্কিত নিয়মকানুনগুলো মেনে চলছে, ঠিক যেমনটা তারা লাইসেন্স প্রাপ্তির আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কঠোর এই প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও মাস দুয়েক সময় লেগে যেতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। সার্বিকভাবে ভারতে সেবা চালুর আগে সর্বশেষ অনুমোদন দেবে দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
ভারতে টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সের জিও এবং ভারতী এয়ারটেল গত মার্চেই মাস্কের স্টারলিংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের রিটেইল স্টোরগুলোতে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা সম্পর্কিত যন্ত্রাংশ মজুদ করতে শুরু করে। কিন্তু তা স্বত্বেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানে তারা একেঅন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে।
শুরুতে ভারতের বাজারে স্টারলিংকের আগমনকে একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জিও ও ভারতী এয়ারটেল। বিশেষ করে ভারতের বাজারে স্যাটেলাইট সার্ভিসের স্পেকট্রাম কীভাবে প্রদান করা উচিৎ তা নিয়ে ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স জিও এবং মাস্কের স্টারলিংকের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ তৈরি হয়। জিও চাইছিল নিলামের মাধ্যমে প্রদান করা হোক স্পেকট্রাম, অন্যদিকে স্টারলিংকের মত ছিল নিলামের পরিবর্তে সার্বিক যোগ্যতা বিবেচনা করে প্রদান করা হোক স্পেকট্রাম লাইসেন্স। মোদি সরকার অবশেষে নিলাম ছাড়াই স্পেকট্রাম প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
মে মাসে ভারতের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রস্তাব দেয়, দেশটিতে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বার্ষিক আয়ের ৪ শতাংশ ভারত সরকারকে প্রদান করতে হবে। স্থানীয় সেবাদাতারা এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে জানায়, অর্থের পরিমাণটা ‘অযৌক্তিকভাবে কম’ এবং এর ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিলয়েটের পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড সেবার বাজার দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তাই স্টারলিংক ও অ্যামাজন ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এসএম/টিএ