বাংলা ভাষায় কথা বলায় পাঁচ ভারতীয় বাঙালীকে বাংলাদেশে পুশ ইন করার অভিযোগ উঠেছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। ফজের, তাসলিমা, নাজিমুদ্দিন, মিনারুল ও মুস্তাফা নামের এই পাঁচ শ্রমিক প্রত্যেকেই ভারতীয় নাগরিক। সকলেরই দেশটির ভোটার কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে। এদের মধ্যে কারও কারও আবার ভারতীয় পাসপোর্টও আছে।
এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে সরকারি হস্তক্ষেপে ফের নিজের দেশে ফেরত নেয়া হয়েছে এই পাঁচ ভারতীয়কে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেবল বাংলায় কথা বলাটাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও মুম্বাই পুলিশের কর্মকর্তারা সেই সব নথি ছিড়ে ফেলে বলেও অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি মহারাষ্ট্র পুলিশ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাগদা থানার হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা ফজের মন্ডল ও তার স্ত্রী তাসলিমা মন্ডলকে বাংলাদেশে পুশ ইন করে। এরপর গত ১৪ জুন পরিবারের পক্ষ থেকে বাগদা থানাতে অভিযোগ জানানো হয়। অভিযোগে বলা হয়, ভারতীয় সব নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও বেআইনিভাবে ফজের ও তার স্ত্রীকে বাংলাদেশে পুশ করে বিএসএফ।
গত রোববার (১৫ জুন) এই খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হবার পর নড়েচড়ে বসে রাজ্য সরকার। পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি বিএসএফকে জানানো হয়। পরদিন সোমবার সন্ধ্যায় দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে পুনরায় ফজের ও তার স্ত্রীকে ভারতের হাতে তুলে দেয় বিজিবি।
এরপর সে রাতেই বাগদায় নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছায় তারা। ছেলে-বৌমাকে ফিরে পেয়ে খুশি ফজেরের পরিবার। তাদের অভিযোগ, মুম্বাই পুলিশ গ্রেফতার করার পর তাদের আদালতে না তুলে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে পুশ করে।
বাগদার বাসিন্দা ফজের মন্ডল জানান, হঠাৎ একদিন রাত ২টা নাগাদ নয়ানগর থানার পুলিশ এসে আমাকে ও আমার স্ত্রী তাসলিমা মন্ডলকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ‘বৃহৎ মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন’ (বিএমসি)-র একটা অফিসে রাখা হয়। সেখানে চার-পাঁচ দিন রাখার পর আমাদের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। পরে বিএসএফের হাতে হস্তান্তর করা হয়। এরপর একদিন বিমানে উঠিয়ে দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় এবং সেখান থেকে গাড়িতে করে নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঢুকে কিছুদূর যাওয়ার পর বিজিবির হাতে ধরা পড়ি। সেখানে বিজিবি ভারতে পুনরায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। পরে গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়ে যাওয়ায় গত ১৬ জুন আমরা ফের ভারতে ফিরে আসি।
অন্যদিকে কুচবিহার জেলার জামালদাহ সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সোমবার (১৬ জুন) বাংলাদেশে পুশ ইন করা তিন ভারতীয় নাগরিক ফের নিজ দেশে ফিরে আসে। তারা হলেন, মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মন্ডল ও মিনারুল শেখ এবং পূর্ব বর্ধমান জেলার বাসিন্দা মুস্তাফা কামাল শেখ।
জানা গেছে, এই তিনজন মুম্বাইয়ে কাজ করতো। সেখানেই বাংলাদেশি সন্দেহে স্থানীয় পুলিশ তাদের আটক করে। পরে তাদের ত্রিপুরা হয়ে কোচবিহারের সীমান্ত দিয়ে তাদের বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়।
ভারতীয়দের বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর স্থানীয় পুলিশ কর্তব্যরত বিএসএফ’এর সাথে কথা বলে। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে জামালদাহ সীমান্ত দিয়েই তাদেরকে দেশে ফেরানো হয়। ভারতে যাওয়ার পর গতকাল সোমবার মাথাভাঙার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সন্দীপ গড়াই তার অফিসে ওই তিন নাগরিককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা মোস্তফা কামাল শেখ বলেন, আমি মহারাষ্ট্রের নালাসোপরায় কাজ করি। কাজ শেষে প্রতিদিন রাত দুটো নাগদ বাসায় ফিরি। গত ৯ জুন আমার বাসায় পুলিশ আসে। এরপর আমাদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে সমস্ত নথি যাচাইয়ের জন্য থানায় যাওয়ার কথা বলে। তখন আমি তাদের ভারতীয় প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখাই। একসময় আমার মোবাইলটি পরীক্ষা করা হয়। সেই মোবাইলে বাংলাদেশি ফোন নাম্বার দেখে তার ভিত্তিতে আমাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে আখ্যা দেয়া হয়। আমাদের প্রথমে মিরা রোডে নিয়ে গিয়ে নথি যাচাই-বাছাই হয়, এরপর সেখান থেকে পামবেল তারপরে পুনেতে বিএসএফের সদর দফরে পাঠায়। পরে সেখান থেকে বিমানে করে আগরতলায় পাঠানোর পর সেখান থেকে বাংলাদেশে পুশ করা হয়। তারপর সেখান থেকে বাড়ির ফোন নাম্বার নিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করি। এরপর পুলিশের সহযোগিতায় আমরা দেশে ফিরে আসি।
ফজের অভিযোগ করেন, মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে কলকাতায় আসার আগে বিমানবন্দরেই আমাদের যাবতীয় ভারতীয় পরিচয়পত্র ছিড়ে ফেলা হয়, এমনকি আমার দুটো মোবাইল ফোনও ভেঙে ফেলা হয়।
তবে এই অভিযোগ নতুন নয়। মাঝেমধ্যেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানাসহ ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো থেকে আটকের পর বাংলাদেশে পুশ ইনের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া,পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাভাষী রাজ্যগুলির বাসিন্দাদের বাংলাদেশি বলে আখ্যা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে তখন বিস্তর আলোচনাও হলেও নির্দিষ্ট সময়ের পর তা চাপাও পড়ে যায়।
কিন্তু এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। একদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এই অভিযোগ তোলেন। বক্তব্যে বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারকে নিশানা করতে দেখা যায় মমতাকে।
মমতা বলেন, ‘আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে, কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বললেই ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি বলে তকমা দিয়ে সেদেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলায় কথা বলাটা যেমন কারও কাছে গর্বের; ঠিক তেমনিই গুজরাটি, মারাঠি ভাষায় যারা কথা বলছে, তাদের কাছেও মাতৃভাষায় কথা বলাটা গর্বের।
মমতার আরও বলেন, একদিকে বাংলা কথা বলার জন্য আপনি ভারতীয়দের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করছেন, আবার অন্যদিকে ভোটার, প্যান এবং আধার কার্ডধারী মানুষদের জীবিকা নির্বাহের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন।
উল্লেখ্য, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরই গোটা ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত ও ধরপাকড়ে অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে বাংলাদেশি সন্দেহে গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, আসামসহ একাধিক রাজ্যে কয়েকশত ব্যক্তিকে আটক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু করে ভারত সরকার।
সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে কিছু না বললেও বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে ‘পুশ ব্যাক’ নীতি নিয়েছে ভারত সরকার। এর মধ্যে প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক যেমন আছেন, তেমনি ভারতীয় নাগরিককেও বাংলাদেশি বলে ‘পুশ ব্যাক’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এফপি/টিএ