‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে খ্যাত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের প্রয়াণ দিবস আজ। ঠিক পাঁচ বছর আগে, ৬ জুলাই তারিখে, কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন বাংলা গানের এই অবিস্মরণীয় নক্ষত্র। তাঁর মৃত্যুতে সংগীতজগতে সৃষ্টি হয় এক অপূরণীয় শূন্যতা। দীর্ঘ সংগীত জীবনে ১৫ হাজারেরও বেশি গান উপহার দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন এই মহান শিল্পী।
মূলত মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ সব অনুভূতির গানই তার কণ্ঠে পেয়েছে অনন্য মাত্রা। তার শত শত কালজয়ী গান এখনও মানুষের মুখে মুখে। এর মধ্যে ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’ ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’ ‘এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না’সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান আজও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দেশের সংগীত জগতের এই বিশাল নক্ষত্র নিজের কাজে ছাপ রেখেছেন বলিউডের সাম্রাজ্যেও।
আর.ডি. বর্মনের সুরে ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি সিনেমা ‘শত্রু’র গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর। তাঁর গাওয়া ‘ম্যায় তেরা বিসমিল হুঁ’, ‘সুরজ চান্দা সাগর পর্বত’ শিরোনামে দুটি গান শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। বাংলায় ‘বিরোধ’ নামে মুক্তি পেয়েছিল।
মুম্বাইয়ে গানের রেকর্ডিংয়ের স্মৃতিচারণা করে একবার দেশের এক সংবাদমাধ্যমে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ‘শত্রু’ নির্মাণ করেছেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার প্রমোদ চক্রবর্তী।
তিনি সোজা গিয়ে উঠেছিলেন পরিচালক প্রমোদ চক্রবর্তীর মুম্বাইয়ের বাড়িতে। এন্ড্রু কিশোর বলেন, ‘প্রমোদদা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর (আর.ডি. বর্মন) সঙ্গে। বুঝলাম, অমায়িক ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি। ভদ্রলোক কেন জানি আমাকে পছন্দ করে ফেললেন। বললেন, ঢাকাইয়া, (আমাকে তিনি ঢাকাইয়া বলে ডাকতেন) তুই প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার বাসায় চলে আসবি। আমি কাজ করব, তুই দেখবি। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ, একজন সংগীত পরিচালক কখনো তাঁর কাজের সময় অন্য কারও উপস্থিতি কামনা করেন না। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে বললেন, এই হলো ঢাকাইয়া, ও যখন আসে দরজা খুলে দিবি, যা খেতে চায় খাওয়াবি। কয়েক দিন কাটল। আমি নিয়মিত উনার বাসায় আসা-যাওয়া করলাম। এদিকে তিনি গানটা সুর করে ফেললেন।’
![]()
এন্ড্রু কিশোরকে মুম্বাইয়ে থাকার অনুরোধ করেছিলেন আর.ডি. বর্মন। সেই স্মৃতি স্মরণ করে এন্ড্রু কিশোর বলেন, ‘যেদিন আমি দেশে ফিরব, সেদিন বিদায় নিতে গেলে পঞ্চমদা (আর.ডি. বর্মন) আমাকে বললেন, ‘ঢাকাইয়া, তুই হয়তো ভাবছিস, মাঝেমধ্যে ডাকব, গাওয়াব। কিন্তু আমাদের দেশাত্মবোধটা খুব বেশি। কিছু করতে চাইলে এখানে থাকতে হবে। তুই মুম্বাইয়ে থেকে যা। বিয়েশাদি করিসনি। সে ব্যবস্থাও আমি করে দেব। কিন্তু আমি তখন তাঁকে বললাম, দাদা, আমার দেশেই আমি অনেক ভালো আছি। তিনি তখন আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, তুই একটা বাঘের বাচ্চা।’
‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোর জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার ও দুবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। ১৫ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর, যা বাংলাদেশি শিল্পীদের ক্ষেত্রে বিরল দৃষ্টান্ত। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ প্রভৃতি।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালের ৬ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এন্ড্রু কিশোর। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এন্ড্রু কিশোরকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে ধরা পড়ে ক্যান্সার। সেখানে তিনি কয়েক মাস চিকিৎসা নেন। পরে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিলে তাকে নিজের ইচ্ছেতেই ২০২০ সালের ২০ জুন রাজশাহীতে আনা হয়। এরপর তিনি মহানগরীর মহিষবাথানে বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় বসবাস শুরু করেন। ৬ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৫ জুলাই রাজশাহী সার্কিট হাউস সংলগ্ন খ্রিস্টান কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।