জুলাই আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়েছে: কামার আহমাদ সাইমন

ছবিটির জন্য লোকার্নোর পিয়াতজা গ্রান্দায় ‘ফিচারড ডিরেক্টর’ সম্মাননা পান কামার আহমাদ সাইমন। নির্মাণ, সেন্সর জটিলতা আর মুক্তির পরিকল্পনা- দীর্ঘ ১১ বছরের জার্নি শেষে পর্দায় এসেছে সেই ‘অন্যদিন...’। অথচ শুধু একটি প্রেক্ষাগৃহে, তাও রোজ একটি প্রদর্শনী। এর পেছনেও আছে কারণ।

ফিকশন-ননফিকশন ঘরানার হাইব্রিড ফিচারটি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে কথা বলেছেন কামরুল ইসলাম।

সাত বছর ধরে ‘অন্যদিন...’ বানালেন। এরপর তা দুই বছর সেন্সরে আটকে ছিল...
হ্যাঁ, তবে সেন্সর বোর্ডের আগে আমার কাছে, মানে সেলফ সেন্সরেও প্রায় দুই বছর ছিল ছবিটি। সব মিলিয়ে ১১ বছরের জার্নি।

২০২১-এ বিখ্যাত উৎসব ইডফার [ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভাল আমস্টারডাম] মূল প্রতিযোগিতায় ছবিটা নির্বাচিত হলো।

তখন প্রিমিয়ারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। প্রদর্শনীর আগে তাঁরা বেশ আনন্দিত ছিলেন, গৌরব অনুভব করছিলেন। কিন্তু প্রদর্শনীর পর তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান।

পরে জানান, ছবিটা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। তাঁদের প্রতিক্রিয়ার পর নিজ থেকে একটু চুপচাপ হয়ে গেলাম। সময় নিচ্ছিলাম, কিভাবে কী করা যায়। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের উৎসবে গিয়েছি। সবশেষে ২০২৩-এ ছবিটা সেন্সরে জমা দিলাম। সেখানে দুই বছর আটকে থাকে।

এই যে একটি ছবির পেছনে ১১ বছর ব্যয় করা; কখনো মনে হয়েছে এটা অতিরিক্ত কিংবা অহেতুক?

আমি সময় নিয়েই ছবি বানাই। আবার ওভারল্যাপিং করি, মানে একটা ছবির সঙ্গে আরেকটা ছবির কাজও এগিয়ে নিই। তা ছাড়া স্বভাবেও আমি একটু ধিরস্থির মানুষ। তবে হ্যাঁ, ২০২২-২৩-এর দিকে মনে হয়েছিল, ছবিটবি আর বানাব না।

সেন্সর বোর্ড থেকে দুই পাতার একটা চিঠি দিয়েছিল। সেন্সর বোর্ডই বলছি, সচেতনভাবেই। কারণ নাম বদলালেই কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্য বদলে যায় না। সার্টিফিকেশন হলেও এখনো সেই ২২ সালের নীতিমালায় চলছে, যেটা চলচ্চিত্রের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক একটা নীতিমালা। এটাকে ‘কালা সেন্সর’ বলা যায়। তো, শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ না, যে কোনো কাজই করুন না কেন, তাতে আপনার জীবনের একটি টুকরা চলে যায়। সেই খরচের হিসাবটা কেউ করে না।

ফলে একটা ব্যথা তো পেয়েছিলামই, এখনো সেটার রেশ রয়ে গেছে। জুলাই আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়েছে। আগের যত প্রজন্মের ওপর আমরা আস্থা রেখেছিলাম, ব্যতিক্রম কিছু বাদে বাকি সবাই আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের উত্খাতের আন্দোলনও ছিল জুলাই। দেখুন, আমাদের রাজনৈতিক, কালচারাল এলিট যে গোষ্ঠী, তাঁরা কখনো দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এড্রেসই করেনি। এই যে জুলাইয়ে যারা এত বড় অভ্যুত্থান করল, তাঁরা কিন্তু এক প্রকার নো ওয়ান ছিল। সেই নো ওয়ান থেকে সামওয়ান হওয়ার লড়াই ছিল জুলাই।

‘অন্যদিন’-এ কারা অভিনয় করেছেন? মানে এখানে অভিনয় অঙ্গনের কেউ সেভাবে নেই। তাহলে কিভাবে শুটিং করলেন?
পোস্টারে যাদের মুখ আছে, তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটি চরিত্র। সবাইকে গ্রুম করেছি, চিত্রনাট্য অনুযায়ী তৈরি করে নিয়েছি। কারো ক্ষেত্রে এক মাস, কারো ক্ষেত্রে ছয় মাস সময় লেগেছে। আবার কাউকে দিয়ে একদম অনস্পট শুটিং করতে পেরেছি। আমার আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের অনেকেও আছে ছবিতে। চিত্রনাট্য অনুযায়ী যাকে যেভাবে উপযুক্ত মনে হয়েছে, তাকেই নিয়েছি।

এ ধরনের ছবি নির্মাণের ভাবনা কিভাবে মাথায় এলো?
‘শুনতে কি পাও’ [২০১২] নির্মাণের পর ভেবে দেখলাম, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমি আসলে যেটা বলতে চাই, সেটা এখনো পুরোপুরি বলা হয়নি। আমার চলচ্চিত্রের চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে সাহিত্য ঘিরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-আমার প্রিয় পাঠ্য। তাঁদের লেখা পড়েই আমার চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত হয়েছে। ‘অন্যদিন...’-এর চিত্রনাট্যও কিন্তু প্রথমে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির মতো লিখেছিলাম। এরপর সাত বছর ধরে নানা ধাপে কাটছাঁট হয়েছে, সমান্তরালে চলেছে শুটিং।

ছবিটা নিয়ে অনেক দিন ধরে প্রচারণা করেছেন, বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। তবু মাত্র একটা হলে একটা শো পেল! কারণ কী?
এটা প্রথম থেকেই ডিজাইন করা। স্টার সিনেপ্লেক্স ছবিটা নেবে, তাঁরা বলেছিল বসুন্ধরা শাখায় চালাতে। আমি সেটাও রাজি হইনি। আমার শর্তই ছিল, একটি হলে চলবে, সেটা সীমান্ত স্কয়ারে। এ ছাড়া ব্লকবাসস্টার সিনেমাসসহ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ আগ্রহ দেখিয়েছিল, আমরা দিইনি। দেখুন, এই ছবি নির্দিষ্ট কিছু দর্শকের জন্য। সবার কাছে নিয়ে গেলে তো গালি খেতে হবে! এ জন্য আমি চেয়েছি, আমার দর্শকরা একটি জায়গায় এসে ছবিটা দেখুক। এ বিষয়টা কাউকে বলার সুযোগ হয়নি, তবে আমি চাচ্ছিলাম এটা পরিষ্কার করতে। দেখুন, প্রেক্ষাগৃহে যেসব ছবি চলে, সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা লাগে, তা হলো ব্যাংকেবল আর্টিস্ট; শিল্পীর পেছনে টাকা লগ্নি করলে তা উঠে আসার সম্ভাবনা।

আমার ছবিতে তো সেটা নেই। কমার্শিয়াল প্যাকেজ ছবির সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতাই তো নেই। সমস্যা হলো, আমাদের এখানে ডাল-ভাত সব এক হয়ে গেছে। আমাদের যদি একটা আর্ট হাউস থাকত, সিনেপেপ্লক্সেও তো ছবিটা দিতাম না। আমার প্রয়োজন শুধু ছবি দেখানোর একটি যুৎসই জায়গা। এটা গ্লোবাল প্রাক্টিস, বহু দেশে হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় দেখবেন, এ ধরনের ছবি অনেক দিন ধরে চলে। কিন্তু সপ্তাহে শো একটি। ফলে যারা ছবিটা দেখতে চায়, তাঁরা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করে ওই একটি শোতে হাজির হয়। এতে করে অনেক দিন পরেও কেউ যদি আগ্রহী হয়, ছবিটা দেখতে পারে। এখন বলি, আমার কাছে দেশে গত কয়েক বছরে নির্মিত সবচেয়ে সুন্দর ছবি মনে হয়েছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’কে। এ ছাড়া ‘মাটির ময়না’, ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’, ‘আম কাঁঠালের ছুটি’ খুব সুন্দর ছবি। কিন্তু ছবিগুলো সেভাবে চলেনি।

এই যে এখন আমি ছবিগুলোর প্রশংসা করলাম, আপনি যদি এগুলো দেখতে চান, কোথায় দেখবেন? আছে কোনো ব্যবস্থা? এক-দুই সপ্তাহ পরই তো ছবিগুলো নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যদি সপ্তাহে একটি শো চালানো হতো, অনেক দিন ধরে ছবিটা প্রদর্শিত হতে পারত।

পরের ছবি ‘শিকলবাহা’ কবে মুক্তি দেবেন?
২০১৪-তে প্রায় একই সময়ে ‘অন্যদিন...’ আর ‘শিকলবাহা’র যাত্রা শুরু হয়। একবার এটার কাজ, আরেকবার ওটা, এভাবেই এগোচ্ছিল। ২১-এ যখন ‘অন্যদিন...’-এর প্রিমিয়ারে সেই সরকারি ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া দেখে পরে ‘শিকলবাহা’র কাজ সম্পন্ন করি এবং সেন্সরে জমা দিই। এক বছর ধরে ছবিটা আটকে রাখে তাঁরা। আমাকে ফোন দিয়ে বলে, চা খেতে যেতে! কেন যাব? যাইনি। পরে ২৩-এ যখন ‘অন্যদিন...’ জমা দিলাম, তখন আবার ‘শিকলবাহা’কে ছাড়পত্র দিয়ে দিল।

একজন নির্মাতার জন্য এটা কত কনফিউজিং সিচুয়েশন বোঝেন! গত বছর ‘শিকলবাহা’ এশিয়ার বৃহত্তম উৎসব সাংহাই ফিল্ম ফেস্টিভালের মূল প্রতিযোগিতা ‘গোল্ডেন গবলেট’-এ অংশ নিয়েছিল। তখনই প্ল্যান করেছিলাম, গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে ছবিটা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেব। সাংহাই থেকে দেশে ফিরলাম ৩০ জুন, এর পরই তো জুলাই অভ্যুত্থানের সূচনা। আবার আটকে গেল ছবিটা। এখন আবার ‘অন্যদিন...’ রিলিজ করলাম। এটার প্রদর্শন জার্নিটা শেষ হোক, এরপর ‘শিকলবাহা’ আসবে।

কেএন/টিকে


Share this news on:

সর্বশেষ

img
টোলপ্লাজায় ৬ জনের প্রাণহানিতে দেড় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রুল জারি Jul 14, 2025
রাজনীতি ক্রিকেটারদের জন্য নয়: জয়াসুরিয়া Jul 14, 2025
অন্যের স্ত্রীকে বিয়ে! আত্মপক্ষ শুনানিতে নাসির-তামিমার জবাব Jul 14, 2025
img
বক্স অফিসে ঝিমিয়ে পড়েছে শানায়ার প্রথম সিনেমা Jul 14, 2025
img
পুরনো বিশ্বাস আর আতঙ্কে তৈরি এক অন্যরকম হরর জগত Jul 14, 2025
ক্যান্সার থেকে বাঁচাবে ৩ পানীয়, দাবি বিশেষজ্ঞদের Jul 14, 2025
আ.লীগের নিবন্ধন স্থগিত হলেও থাকবে নৌকা: ইসি Jul 14, 2025
নয়াপল্টনে ছাত্রদলের কর্মসূচিতে যে দৃশ্য দেখা গেলো Jul 14, 2025
img
সাকিবকে জাতীয় দলে ফেরানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি : বিসিবি সভাপতি Jul 14, 2025
img
চার গুণ বেড়েছে অনলাইন বিদ্বেষমূলক বার্তা, টেনিস তারকারা মানসিক চাপে Jul 14, 2025
img
১০ মাসে অপরাধের পরিসংখ্যন প্রকাশ করল সরকার Jul 14, 2025
img
স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অপসারণ চেয়ে বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ Jul 14, 2025
img
প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার পালাতে বাধ্য হয় : আলী রীয়াজ Jul 14, 2025
img
আবু সাঈদ-মুগ্ধদের জাতীয় বীর ঘোষণা করতে হাইকোর্টের রুল Jul 14, 2025
img
শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কেবিনে নেওয়া হলো ফরিদা পারভীনকে Jul 14, 2025
img
১৫ বগি ফেলে ইঞ্জিন নিয়ে চলে গেল ট্রেন Jul 14, 2025
যে চারটা গুণ থাকলে আপনি ভাগ্যবান | ইসলামিক টিপস Jul 14, 2025
লিটনের ফিফটির খরা কাটলো; ফর্মটা ধরে রাখবেন, নাকি আবারও হারিয়ে যাবেন? Jul 14, 2025
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে যা বললেন মাহদী আমিন Jul 14, 2025
img
ভারতের সিরাজকে শাস্তি দিল আইসিসি Jul 14, 2025