বিচার বিভাগে সংস্কার থামাতে পারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: রেফাত আহমেদ

বিচার বিভাগের ‘অর্থবহ ও টেকসই স্বাধীন অস্তিত্ব’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘তা করতে ব্যর্থ হলে জাতি হিসেবে আইনের শাসন এবং পদ্ধতিগত গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার ঐতিহাসিক সুযোগ নষ্ট হবে। শুধু তাই না, বিভিন্ন খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের স্থায়িত্বেও নিকট ভবিষ্যতে বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। কেবল বিচার বিভাগ নয়, সব ধরনের সংস্কার নির্ভর করছে টেকসই রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির ওপর বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ স্মারক বক্তৃতায় এ কথা বলেন বিচার বিভাগের প্রধান।
প্রখ্যাত আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের বাবা। গত ১২ জুলাই ছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত এই আইনজীবীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দি ইশতিয়াক সেন্টার। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

প্রধান বিচারপতি বলেন, মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার যে দূরদর্শী রূপরেখা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ দিয়েছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক।’

তিনি বলেন, ‘ইশতিয়াক আহমেদ শুধু সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শকই ছিলেন না, তিনি বিচার বিভাগের কাঠামো ও নির্বাহী স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাও দিয়ে গেছেন।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সহ-উপদেষ্টা ছিলেন, অনুষ্ঠানে সে কথাও স্মরণ করেন প্রধান বিচারপতি। পাশাপাশি অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সংবিধানের ১০৯ ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি।

তিনি বলেন, ‘সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ বিশ্বাস করতেন এই দুটি অনুচ্ছেদের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনে সহায়ক। তবে তিনি সতর্ক করে এও বলেছিলেন, ১১৬ এবং ১১৬(ক) অনুচ্ছেদ তামাশায় পরিণত হবে যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করা হয়; বিশেষ করে যেখানে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ৪৮(৩) এবং ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান যৌথ ক্ষমতা প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।’

১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের ব্যাখ্যা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হলেও ১১৬ অনুচ্ছেদে আবার অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ-শৃঙ্খলা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। সংবিধানের দুই (১০৯ ও ১১৬) অনুচ্ছেদের অসংগতি ‘দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা’ তৈরি করেছে বলে মনে করতেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল।’

জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলেন। এই রোডম্যাপ নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই রোডম্যাপ কেবল একটি ঘোষণা নয়, বরং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত এবং জনগণের সেবায় বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার বাস্তব পদক্ষেপ।

তবে পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় যে প্রতিবন্ধকতা আছে বলেও মনে করেন সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক ও বিচারিক স্বার্থের মধ্যে গোপন সম্পর্কের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যারা এর সুবিধাভোগী তাদের কাছ থেকে অনিবার্যভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে। তাছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সবচেয়ে সুচিন্তিত সংস্কারকেও থামিয়ে দিতে পারে। কেবল বিচার বিভাগ নয়, সব ধরনের সংস্কার নির্ভর করছে টেকসই রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির ওপর।

আলোচনায় অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদিন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. এম. মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী, নিহাদ কবির ও মোস্তাফিজুর রহমান খান।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট অরিফ খান। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।

এফপি/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভারত থেকে দেশে ফিরেই গ্রেপ্তার আ.লীগের সাবেক এমপির ছেলে Sep 14, 2025
কাজা নামাজ যেভাবে পড়বেন | ইসলামিক টিপস Sep 14, 2025
'ভারত ছড়ি ঘোরাবে পাকিস্তানের উপর': শোয়েব আখতার Sep 14, 2025
শুল্কজট পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি Sep 14, 2025
img
সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে ফারিয়া সহ কারাগারে ৩ Sep 14, 2025
আওয়ামী লীগ আমলে বানোয়াট মামলার শিকার হাজারো নেতাকর্মী Sep 14, 2025
৮ তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি Sep 14, 2025
ভবিষ্যতে বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন জুমা, জানালেন নিজেই Sep 14, 2025
img
ইসির শুনানিতে অংশ নিলো প্রায় ১ ডজন রাজনৈতিক দল Sep 14, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, দেশজুড়ে বৃষ্টিবলয় কবে থামবে? Sep 14, 2025
img
জুলাই সনদের ভিত্তিতে হলেই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে: জামায়াত Sep 14, 2025
img
নির্ধারিত ছয় মাসের আগেই নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্তের সিদ্ধান্ত Sep 14, 2025
img
কলকাতায় রাতের সৌন্দর্যে প্যারিসের ছোঁয়া Sep 14, 2025
img
‘ব্যাড্স অব বলিউড’ এর চমক নিয়ে আসছে তামান্না ভাটিয়া! Sep 14, 2025
img
ইউরোপীয় ৩ দেশকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি Sep 14, 2025
img
রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ১৬৯৬ মামলা Sep 14, 2025
img
লালনের গানে বিপ্লব এনেছিলেন ফরিদা পারভীন Sep 14, 2025
img
সাদাপাথর লুটকাণ্ডে গ্রেপ্তার সাহাব উদ্দিন কারাগারে Sep 14, 2025
img
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাবর, আলোচনায় তারেক রহমানের নিরাপত্তা Sep 14, 2025
img
প্রকৌশল খাতে লেনদেন শীর্ষে, জীবনবিমায় পতন Sep 14, 2025