ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বক্তব্য

বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বাক্ষরের পর ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের (এইচআরসি) একটি মিশন চালু হওয়ার বিষয়টি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে।

জাতিসংঘের সংস্থাটি মূলত স্থানীয়ভাবে লিঙ্গভিত্তিক অধিকার, আবাসন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বৈষম্য নিরসন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে। তবে যেসব দেশে ওএইচসিআর কাজ করছে, সেগুলোর কিছু কিছু দেশে জাতিগত সংঘাত বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ।

আজ শনিবার প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে সমঝোতা স্মারকের খবরটি শেয়ার করা হলে সেখানে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম।

তিনি লেখেন, ‘যেই কমিশন মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস হতে দিয়েছে, মুসলমানদের টার্গেট করে জঙ্গি ট্যাগ দিয়েছে, পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যকে সার্ভ করেছে, যে কমিশন পুরো পৃথিবী কিংবা মানবতার না হয়ে কয়েকটি দেশ, গুটিকয়েক ব্যক্তি কিংবা কিছু গোষ্ঠীর দালাল হিসেবে কাজ করেছে, সেই তথাকথিত মানবাধিকার কমিশন দিয়ে আমরা কী করব?’

এদিকে ঢাকায় মানবাধিকার কমিশনের অফিস চালু নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো।

আজ ১৯ জুলাই শনিবার সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেওয়া হবে না।’ অবিলম্বে চুক্তি বাতিল না করলে ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেয় তারা।

সংগঠনটি বলছে, এর আগেও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন, ইসলামী শরিয়া ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও একই চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া সমকামী তথা এলজিবিটি ইস্যুটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মানবাধিকার দর্শন ও নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত।

এদিকে মানবাধিকার কমিশনের অফিস খোলা সংক্রান্ত চুক্তি বাতিলের দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি ইমতিয়াজ আলম শুক্রবার একটি সমাবেশে মানবাধিকার দপ্তর স্থাপন প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানসহ দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতনে কী ভূমিকা পালন করেছে? এখন এ দেশে মানবাধিকার দেখাতে চায়?’

ওই সমাবেশে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন থেকে সরকারকে সরে আসতে বাধ্য করা হবে।’

তবে শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তির বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আমরা স্বীকার করি, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলির আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সমাজের একটি অংশের উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অনেক নাগরিক আমাদের জানিয়েছেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক অংশীদারির ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।’

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘এই প্রেক্ষিতে ওএইচসিএইচআর মিশন মানবাধিকারের যেকোনো গুরুতর লঙ্ঘনের প্রতিরোধ ও প্রতিকার, বিগত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর মনোনিবেশ করবে।
এটি দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর বাইরে থাকা কোনো সামাজিক এজেন্ডাকে উৎসাহিত করবে না।’

এই অফিস হলে বাংলাদেশের কী লাভ হবে?

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যা, বেআইনি আটক, গ্রেপ্তার-হয়রানির বহু অভিযোগ ছিল।

সমঝোতা স্বাক্ষরের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, ‘বিগত সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যার দায়মুক্তির যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে সে সময় যদি এই ধরনের একটি সংস্থার কার্যক্রম চলমান থাকত, তাহলে সেই অপরাধের অনেকগুলো ঘটনা হয়ত সঠিকভাবে তদন্ত, লিপিবদ্ধ এবং বিচার করা হত।’

মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বিবিসি বাংলাকে এ বিষয়ে বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের অফিস বাংলাদেশে থাকলে এসব ঘটনার তদন্ত করাটা সহজ হবে।

গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন সেখানে পাঁচ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে। গতবছর যা যা ঘটল, এগুলোর তদন্ত করতে গেলে মানবাধিকারের অফিস এখানে থাকলে সুবিধা হবে।’

ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনগুলো ঢাকায় ওএইচসিআর-এর অফিস চালু না করার পক্ষে যেসব যুক্তি দেখাচ্ছে, সেগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, ‘উনাদের (ইসলামপন্থী দল ও সংগঠন) কিছু তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যক্রমের সাথে বিশ্বের সব দেশ জড়িয়ে আছে। এই কাউন্সিলে বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ অংশগ্রহণ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নারী অধিকার থেকে শুরু করে শিশু অধিকারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নানান বিষয়ে ওএইচসিআর কাজ করে। যারা আপত্তি জানাচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে–– বাংলাদেশে শিশু অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত না।’

তিনি বলেন, ‘শিশুরা যৌন হয়রানিসহ নানা কিছুর শিকার হচ্ছে। শিশু অধিকার সনদ আরো কার্যকরভাবে বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যায়। সেখানে যদি জাতিসংঘ ভূমিকা রাখতে পারে, সেখানে সমস্যাটা কী? এটা প্রত্যাখ্যান করার তো কারণ নেই। এটিকে স্বাগত জানানো উচিত।’

অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খানও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক মনে করেন।

তবে সমঝোতা স্মারকে এই মিশনের সদস্যদের ‘দায়মুক্তি দেওয়া হবে’ বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘সেটা সত্যি হলে মানবাধিকার কর্মীদের জন্য কেন এ রকম একটি বিধান তাদের দরকার হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।’

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
যান্ত্রিক ত্রুটিতে ফার্মগেটে এসে থেমে গেল মেট্রোরেল Jul 21, 2025
img
ক্যামেরা দেখেই হঠাৎ রেগে গেলেন অভিনেতা অমিতাভ Jul 21, 2025
img
আমার কাছের মানুষরাই আমাকে বিশ্বাস করছে না : সালসাবিল Jul 21, 2025
img
জামায়াত আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি : নিলুফার চৌধুরী Jul 21, 2025
img
বারাক ওবামাকে গ্রেফতারের কৃত্রিম ভিডিও শেয়ার করলেন ট্রাম্প Jul 21, 2025
img
মুশফিকুল ফজল আনসারীকে ধন্যবাদ জানালেন জামায়াত আমির Jul 21, 2025
img
যেখানেই মব দেখবেন সেখানেই উচিত শিক্ষা দেবেন : ইশরাক হোসেন Jul 21, 2025
img
দুই দিনের সফরে ৩০ আগস্ট ঢাকায় আসছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী Jul 21, 2025
img
আজ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-নেপালের অঘোষিত ফাইনাল Jul 21, 2025
img
২৯ বছর পর রিয়ালের উইঙ্গারকে দলে টানতে যাচ্ছে বার্সেলোনা! Jul 21, 2025
img
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাহরাইনের তথ্যমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ Jul 21, 2025
img
ধোবাউড়ায় পিকআপ ভর্তি ভারতীয় মদসহ ১ জন আটক Jul 21, 2025
img
ঠোঁট ফুলে বেহাল দশা উরফি জাভেদের Jul 21, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে টি-২০ অভিষেকে ওয়েনের দুর্দান্ত ফিফটি Jul 21, 2025
img
লামিমার কারণে বিয়ে আটকে গেছে শিমুলের! Jul 21, 2025
img
সন্ধ্যার মধ্যে দেশের ৭ অঞ্চলে বজ্রসহ ঝড়ের আভাস Jul 21, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে সর্বোচ্চ শুল্কহার! কার্যকর ১ আগস্ট থেকে Jul 21, 2025
img
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা Jul 21, 2025
img
শেখ হাসিনা-নিজাম হাজারীসহ দুই শতাধিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে যাচ্ছে পুলিশ Jul 21, 2025
img
উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটি, ৪০ মিনিট আকাশে চক্কর দিয়ে অবতরণ ইন্ডিগোর Jul 21, 2025