ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমকে ডিও লেটার (আধা সরকারিপত্র) দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গত ৩ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এই ডিও লেটার দেন। গত শুক্রবার (৮ আগস্ট) রাতে বিষয়টি জানাজানি হয়।
এর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের পথ সুগম হলো বলে মনে করা হচ্ছে। শিগগিরই এর অনুমোদন মিলবে বলেও আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর দেয়া পত্রে উল্লেখ করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন জনপদ। এ জেলায় রয়েছে নয়টি উপজেলা এবং ২০১১ সালে আদমশুমারি তথ্য অনুযায়ী জেলার জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৮ জন। অতি প্রাচীনকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, কারুশিল্প, কুটিরশিল্প, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশে সুপরিচিত।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নেই। ফলে জেলার দরিদ্র ও অসহায় জনসাধারণ বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা হতে বঞ্চিত। জেলা সদরের স্থাপিত সদর হাসপাতালে ডাক্তার স্বল্পতাসহ আধুনিক চিকিৎসার তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা নেই।
এলাকার জনসাধারণকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকা শহরে আসতে হয়। কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণ বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে সক্ষম নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হলে দরিদ্র জনসাধারণ বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ পাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হলে জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী উপজেলার জনসাধারণ নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য সেবা পাবে।
অর্থ উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবস্থান ঢাকা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। জেলার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের উভয় প্রান্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর অবস্থিত। সড়ক দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য গুরুতর রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য ঢাকা শহর ছাড়া নিকটবর্তী কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে যাতায়াত খরচসহ ঢাকা শহরে অবস্থান করে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা দুরূহ।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা দ্বিতীয়। এ জেলা হতে লাখ লাখ দক্ষ-অদক্ষ, এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরি করছেন। তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ সরকারের আমদানি ব্যয় অনেকাংশে মিটানো হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম তিতাস গ্যাস ফিল্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।
এছাড়া অর্থ উপদেষ্টার ডিও লেটারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কৌশলগত অবস্থান, ঘন জনবসতি, ঐতিহ্য ও জাতীয় অর্থনীতিতে এই জেলার অবদান বিবেচনা করে জেলা সদরে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানানো হয়।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, ‘আমাদের জেলায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি, প্রাণের দাবি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে অর্থ উপদেষ্টার দেয়া পত্রের বিষয়টি জেনে ভালো লাগলো। আমরা মনে করি জেলার গুরুত্ব অনুধাবন করে অতি দ্রুত এর বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাবো।’
এ ব্যাপারে জেলা নাগরিক ফোরামের সহ-সভাপতি ও জেলা খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক নিহার রঞ্জন সরকার জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসরকারি শতাধিক ক্লিনিক হাসপাতাল থাকলেও মানসম্মত চিকিৎসা নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালেও উন্নত চিকিৎসা সেবার সুযোগ না থাকায়, কেউ দুর্ঘটনাজনিত কারণে আহত হলে শত কিলোমিটার দূরে ঢাকায় পাঠাতে হয়। ফলে পথের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্রাহ্মণাবড়িয়াবাসী একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। মানববন্ধন আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। তবে অর্থ উপদেষ্টার প্রতিও ডিও লেটার দেয়ায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমরা আশা করি অচিরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল বলেন, ‘আমি এবং জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করি, পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে উনার কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎ করি। আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর দাবির বিষয়টি উনার কাছে তুলে ধরে খোলামেলা আলোচনা করি। পাশাপাশি আমারা উনার কাছে অনুরোধ করি, আপনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নিলে জেলাবাসী বরাবরের মতোই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত হবেন।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের অনুরোধে প্রেক্ষিতে প্রথমে তিনি নারাজ থাকলেও পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর ডিও লেটার দিতে সম্মত হন। পরে আবারও আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি অচিরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী তাদের দীর্ঘদিনের দাবি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রত্যাশাটি পূরণ হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখতে পারবেন। ডিও লেটার দেয়ার জন্য তিনি অর্থ উপদেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
ইউটি/টিএ