চোর সন্দেহে হত্যার শিকার রুপলাল দাসের মরদেহ রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে রেখে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। ময়নাতদন্ত শেষে রোববার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মরদেহ বাড়িতে আনার পর তারাগঞ্জ উপজেলার বেলতলী এলাকায় রেখে বিক্ষোভ করেন তারা। এতে সড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। বিক্ষোভকারীরা দ্রুত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
স্থানীয় সমাজসেবক সাবু খান বলেন, রুপলাল নিরপরাধ। তাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সে বাঁচার জন্য অনেক আকুতি করেছে। তাকে পুলিশ-সেনাবাহিনীকে দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।
ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা নান্নু মিয়া বলেন, আমরা রুপলাল হত্যার বিচার চাই। আসামিদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস না পায়। তারাগঞ্জ পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পাপন দত্ত বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসের হত্যাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আতে হবে। পরে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ইউএনওর আশ্বাসে রাত পৌনে ৮টার দিকে বিক্ষোভ প্রত্যাহার করে নেয় এলাকাবাসী।
রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই (মুচির কাজ) করে বৃদ্ধা মাসহ স্বামী-স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলতো রুপলাল দাসের সংসার। তিল তিল করে কিছু টাকা জমিয়েছেন বড় মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ে দেবেন বলে। বিয়ের কথাবার্তাও চলছিল। দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা গ্রাম থেকে নিজে ভ্যান চালিয়ে বাড়িতে আসছিলেন ভাগ্নি জামাই প্রদীপ দাস। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা ঠিকমতো না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। শনিবার রাত ৯টার দিকে রূপলাল সেখানে পৌঁছে দুজনে ওই ভ্যানযোগে বাড়ির দিকে রওনা হন। তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে এলাকার লোকজন গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে দুজনকেই। ছয় সদস্যের একমাত্র উপার্জনক্ষম রুপলাল দাসের মৃত্যুতে মেয়ের বিয়েসহ সব স্বপ্ন যেন মাটিতে মিশে গেছে।
নিহতের পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার লালচাদ দাসের ছেলে ডিপজল দাসের সঙ্গে। রোববার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য শনিবার মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে ভাগ্নি জামাই প্রদীপ দাস তারাগঞ্জের রুপলাল দাসের বাড়ির দিকে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন।
সেখানে রুপলাল গিয়ে দুজনে ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে আসছিলেন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দুজনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে প্রদীপ দাসের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করে লোকজন। এর একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে অসুস্থ হয়ে পড়েন দুজন। এতে লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে। এরপর ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন।
মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে তাদের বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তাদের। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে (৪০) মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ দাসকে (৩৫) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রোববার ভোরে তিনিও মারা যান।
এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক জানান, গণপিটুনিতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত রুপলাল দাসের স্ত্রী ভারতী দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। কিছু আলামত পাওয়া গেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাইসহ তদন্ত কার্যক্রম চলছে।