সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯৮ ও ১০৫ ধারাসহ সুপারিশ করা ধারাগুলো সংশোধন, বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ২০ ও ২৫ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ বছর করাসহ ৮ দফা দাবি আদায়ে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ সারা দেশে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছিল। তাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের একদিন আগেই সরকারের আশ্বাসে সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রোববার (১০ আগস্ট) বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে সরকারের সঙ্গে পরিবহন মালিক ও শ্রমকদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে শ্রমিকনেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
দাবিগুলোর বিষয়ে যেসব আশ্বাস দিলো সরকার
দাবি-১: সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯৮ ও ১০৫ ধারাসহ সুপারিশ করা ধারাগুলো সংশোধন করা
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯৮ ধারায় বলা আছে, ওভারলোডিং যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মোটরযান চালনার ফলে দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের দণ্ড— ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদানের নির্দেশ দিতে পারিবে।
এই ধারার প্রস্তাবে পরিবহন মালিকরা প্রস্তাব করেছেন— অনধিক ৩০ হাজার টাকা জরিমানা বা অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং আদালত জরিমানা সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদানের নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে। এই আইনটির অপব্যবহার বন্ধ করা এবং কন্ডাক্টর সুপারভাইজার সহায়তাকারীকে এই মামলায় আসামি করা যাবে না। ধারাটি জামিনযোগ্য করতে হবে।
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ১০৫ ধারা বলা আছে- দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অপরাধ এই আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হইলে বা তাহার প্রাণহানি ঘটিলে, তৎসংক্রান্ত অপরাধসমূহ Penal Code, 1860 (Act No. XLV of 1860)-এর এতৎসংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, Perual Code, 1860 (Act No. XLV of 1860)-এর section 304B এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হইলে বা তাহার প্রাণহানি ঘটিলে, উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এই ধারার প্রস্তাবে পরিবহন মালিকরা প্রস্তাব করেছেন— অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ৩ বছর কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ড এবং ধারাটি জামিনযোগ্য করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, আগামী সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে বিভিন্ন অংশীজনের মতামত গ্রহণ করে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আয়োজন করে সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ এর সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত করতে হবে।
দাবি-২: যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করা
প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, বাস মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করা হলো।
এ বিষয়ে পরিবহন মালিকরা প্রস্তাব করেছেন— বাস ও মিনিবাস এবং ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ২০ ও ২৫ বছরের স্থলে ২৫ ও ৩০ বছর নির্ধারণ করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ইকনোমিক লাইফ উত্তীর্ণ মোটরযান সড়ক থেকে প্রত্যাহার এবং নতুন মোটরযান ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট মোটরযান মালিকদের ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দাবি-৩: রিকন্ডিশন্ড যানবাহনের আমাদানির মেয়াদ বাড়ানো
বলা আছে, বাণিজ্যিক রিকন্ডিশন্ড যানবাহন (বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইম মুভার) আমদানির মেয়াদ থাকবে ৫ বছর।
এ বিষয়ে পরিবহন মালিকরা প্রস্তাব করেছেন— মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রাস্তা থেকে সরানোর জন্য সহায়ক হিসেবে বাণিজ্যিক রিকন্ডিশন যানবাহন (বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইম মুভার) আমদানির মেয়াদ ৫ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ১২ বছর করতে হবে। উল্লেখ্য, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মান এ সকল দেশের রিকন্ডিশন গাড়ি বর্তমানে আমাদের দেশের নতুন গাড়ির চেয়েও আরামদায়ক, টেকসই, পরিবেশ বান্ধব এবং দামও তুলনামূলক অনেক কম। যাতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রাস্তা থেকে পর্যায়ক্রমে অপসারণের সহায়ক হিসেবে জাপানি ও ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের বাণিজ্যিক রিকন্ডিশন্ড যানবাহন (বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইম মুভার) ৫ বছরের ব্যবহৃত হতে বৃদ্ধি করে ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহৃত যানবাহন আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দাবি-৪: সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ১১০ সংশোধন করা
ধারায় বলা আছে- ওয়ারেন্ট ব্যতীত গ্রেপ্তারের ক্ষমতা (১) কোনো পোশাকধারী পুলিশ অফিসারের সম্মুখে কোনো ব্যক্তি ধারা ৭২, ৭৩, ৭৫, ৭৭, ৭৯, ৮৪, ৮৬, ৮৯, ৯২(১), ৯৮ বা ১০৫ এর অধীন শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ করিলে, তিনি উক্ত ব্যক্তিকে ওয়ারেন্ট ব্যতীত গ্রেপ্তার করিতে পারিবেন। (২) উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রয়োজনে কোনো পুলিশ অফিসার ওয়ারেন্ট ব্যতীত কোনো মোটরযানের চালককে গ্রেপ্তার করিলে, তিনি উক্ত মোটরযানের নিরাপদ হেফাজতের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, বা মোটরযান নিকটতম থানায় লইয়া যাইবেন। (৩) উপধারা (১) ও (২) এর অধীন দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ অফিসার, যথাশ্রীঘ সম্ভব, তবে কোনো ক্রমেই চব্বিশ ঘণ্টার অধিক নহে, সংশ্লিষ্ট মোটরযানের মালিককে মোটরযানটি কোথায় স্থানান্তর করা হইয়াছে এবং চালককে কোথায় লইয়া যাওয়া হইয়াছে তাহা অবহিত করিবেন।
এ বিষয়ে পরিবহন মালিকরা প্রস্তাব করেছেন— দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি থানায় আটক হলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মালিকের জিম্মায় দেওয়ার বিধান রয়েছে। যা বাস্তবে কার্যকর হয় না। এটি কার্যকর করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত মোটরযান বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আটক হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ রকম মোটরযানের তালিকা সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবরে দাখিল করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দাবি-৫: মেয়াদোত্তীর্ণ পুরাতন যানবাহনের জন্য স্ক্র্যাপ নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা- ২০২৪ এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়ার ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন হতে মতামত পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করা হবে।
দাবি-৬: মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহনসহ (অটো-টেম্পু, অটোরিকশা) বিআরটিএ অনুমোদনবিহীন হালকা যানবাহনের জন্য পৃথক লেনে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সকল সড়ক, মহাসড়কে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক সার্ভিস লেন তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দাবি-৭: ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নবায়ন দ্রুততার সাথে ডেলিভারি দিতে হবে এবং শ্রমিক ফেডারেশনের ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন দ্রুততার সাথে সম্পাদনের লক্ষ্যে কিউআর কোডযুক্ত ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রবর্তন করা হয়েছে। যা অনলাইনে (www.bsp.brta.gov.bd) ডাউনলোড করে প্রিন্ট করার সুযোগ রয়েছে। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স দ্রুততার সাথে সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিআরটিএ ইস্যুকৃত ই-লাইসেন্স সর্বক্ষেত্রে ভ্যালিড বলে বিবেচিত হবে। প্রিন্টেড সস্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই বলে ট্রাফিক পুলিশ এ বিষয়ে মামলা করবে না।
দাবি-৮: আমদানি করা (টায়ার-টিউব, লুব্রিকেন্ট, ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি, ব্রেকসুসহ) যন্ত্রাংশের মূল্য প্রায় দেড়গুণের অধিক এবং জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে পরিবহন সেক্টরে যে কোনো সময় অচলাবস্থার সৃষ্টির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সে প্রেক্ষিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ‘ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহন সেক্টরের’ গণপরিবহন খাতে অগ্রিম বর্ধিত কর আরোপ না করা।
একইসঙ্গে বাজেটে বাণিজ্যিকভাবে চলাচলকারী যানবাহনের ওপর আরোপিত দ্বিগুণ অগ্রিম আয়কর (প্রিজাম্পটিভ ইনকাম ট্যাক্স) কমিয়ে পূর্বের ন্যায় বহাল রাখতে হবে। অনেক মালিকের আয় ৩ লাখ টাকার নিচে, তার এআইটি সমন্বয় করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে ব্যাংক/লিজিং কোম্পানি থেকে লোনের স্ব-স্ব মাধ্যমে নেয়া গাড়ি কোম্পানি/ব্যাংকের নামে রেজিস্ট্রেশন থাকে এবং মালিকরা তাদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে গাড়ির দেনা পরিশোধ করে থাকেন। সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ হওয়ার পর স্ব-স্ব মালিকের নামে গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয়। তার আগ পর্যন্ত ব্যাংক/লিজিং কোম্পানির টিন নাম্বারের মাধ্যমে এআইটি জমা হয়।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগের গত ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর ৩১ সংখ্যক স্মারকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পত্র দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক যানবাহনের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়করের বিধি পরিবর্তন করে প্রিজাম্পটিভ ট্যাক্স হিসেবে সিদ্ধান্ত জরুরিভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আগামী বাজেটে বর্তমান নির্ধারিত অগ্রিম আয়কর (যা প্রিজাম্পটিভ ট্যাক্স হিসেবে পরিবর্তিত হবে) কমানো এবং এই বছরে আরোপিত অতিরিক্ত এআইটি যৌক্তিকভাবে কমানোর বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে মালিক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দ্রুত সভা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এছাড়া সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আইন, ২০০৫ সক্রিয়ভাবে চালু করার বিষয়ে জানালে সেটি বিবেচনাধীন আছে বলে সভায় জানানো হয়।
বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন, সড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হক, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলমসহ বাস-ট্রাকের বিভিন্ন পরিবহনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।