রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টিভি উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হলো জুলাই সনদ। কেউ একে বলছেন গণ-অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। কেউ বলছেন রাজনৈতিক সংস্কারের এক নতুন রূপরেখা। আর অনেকে একে দেখছেন সংবিধানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক বিপজ্জনক দলিল হিসেবে।
সম্প্রতি নিজের ইউটিউব চ্যানেলের এক ভিডিও বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সাল থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সাতের দুই অনুচ্ছেদে লেখা আছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক অন্য যেকোনো আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। এমন একটি ভিত্তি আইনকে পাশ কাটিয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলো একটি নতুন সনদ তৈরি করে এবং ঘোষণা দেয় যে এর বিধান আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না; তাহলে সেটি কেবল অসাংবিধানিক নয় ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেবে।
তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালের ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করে অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন। এরই ধারাবাহিকতাই এলো জুলাই সনদ— যাতে আন্দোলনের দাবি, সংস্কার ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ হলো। কিন্তু এখানেই তৈরি হলো বিভ্রান্তির ফাঁদ। সনদে ৮৪টি বিষয় রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অনুচ্ছেদ ৭০, মৌলিক অধিকার, ভাষা ও নাগরিকত্ব, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারণ, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্ণ ঐকমত্য নেই। তবু প্রস্তাবিত সনদ বলছে যদি কোনো আইন বা সংবিধানের ধারা এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তবে জুলাই সনদ প্রাধান্য পাবে। আরো বলা হয়েছে এই সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে সনদ হয়ে উঠছে সংবিধানের সমান্তরাল।
এমনকি ঊর্ধ্বতন এক দলিল।’
জিল্লুর বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম চেষ্টার নজির আছে। পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছিল আদালত। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছিল আদালত। আবার সেই রায়ের রিভিউতেও বিতর্ক হয়েছে। আদালত প্রমাণ করেছে সংবিধানের কোনো অংশই চিরস্থায়ী নয়। প্রশ্নাতীত নয়। তাহলে একটি রাজনৈতিক সনদকে যদি প্রশ্নাতীত করা হয় সেটি কি আইনের শাসনের পরিপন্থী নয়?’
জিল্লুর আরো বলেন, ‘আজকের রাজনীতি মূলত ট্যাগ আর প্রচারণার খেলা। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের পর সুযোগ ছিল নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য আনার। কিন্তু ভুল কৌশল, ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারা, চাঁদাবাজির সংস্কৃতিতে সেই সুযোগ হারিয়ে গেছে। জুলাই সনদ যদি সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান পায় তবে বিভাজন আরো গভীর হবে। রাজনীতি আসলে এখন দায় স্বীকার না করে দায় চাপানোর শিল্পে পরিণত হয়েছে।’
এফপি/ টিকে