ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নৌবাহিনী আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরে নতুন কৌশলগত নৌ মহড়ার আয়োজন করতে যাচ্ছে। সোমবার রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ইরানের নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শহরম ইরানি এই ঘোষণা দেন।
ইরানি নৌবাহিনীর প্রধান জানান, "আমাদের সামনে একটি যৌথ নৌমহড়া রয়েছে যা শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে।" ইরানি নৌবাহিনী কাস্পিয়ান সাগরে তাদের উপস্থিতি জোরদার করতে গত দুই দশক ধরে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ইরান প্রথমবারের মতো এই সাগরে টহল জাহাজ মোতায়েন করে।
ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত নৌযানের ইতিহাস
ইরানের সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ও বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর উপ-সমন্বয়কারী অ্যাডমিরাল হাবিবুল্লাহ সাইয়ারী অতীত স্মরণ করে বলেন, ১৯৯৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশে আমাদের নৌবাহিনীতে ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত জাহাজ নির্মাণের সূচনা হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ইরানের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র নৌযান 'পেইকার' নর্দার্ন ফ্লিটে যোগ দেয়। এটি নৌশাহরে নির্মিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কার্যক্রমে অংশ নেয়।
গত দুই দশকে ইরান তাদের নৌ সক্ষমতা শুধু দক্ষিণাঞ্চল, পারস্য উপসাগর ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় নয়, বরং উত্তর দিকে কাস্পিয়ান সাগরেও ব্যাপকভাবে বিস্তার করেছে। এটি নিয়মিত বিভিন্ন নৌমহড়া ও টহল অভিযান পরিচালনা করছে।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাচাই ও কূটনৈতিক তৎপরতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত 'এখতেদার পায়দার ২০২৫' নামের নৌ-ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া ইরানের কাস্পিয়ান উপস্থিতির একটি দৃষ্টান্ত। ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রচার দপ্তর জানিয়েছে, এই মহড়ার মাধ্যমে ইরান তাদের স্বনির্ভর নৌ প্রযুক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং উপকূলীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা যাচাই করছে।
নতুন যুদ্ধজাহাজ: কাস্পিয়ান অঞ্চলে ইরানের কার্যক্রম শুধুমাত্র সামরিক মহড়ায় সীমাবদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন যুদ্ধজাহাজ 'দেইলামান' ফ্লিটে যুক্ত হওয়ায় তেহরানের উপস্থিতি আরো দৃঢ় হয়েছে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা: ইরান, রাশিয়া ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে।
রিয়ার অ্যাডমিরাল শহরম ইরানি রবিবার রাতে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান রাশিয়ায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত কাদিয়াম জালালী এবং রুশ নৌবাহিনীর উপ-প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির জেমোৎসফ।
ইরানি নৌপ্রধান এ সফরে কাস্পিয়ান সাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোর নৌবাহিনীর প্রধানদের সম্মেলনে অংশ নেবেন। এছাড়া তিনি রুশ নৌবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, আজারবাইজান ও কাজাখস্তানের নৌ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা এবং গালফ অফ ফিনল্যান্ডে অবস্থিত কয়েকটি নৌঘাঁটি পরিদর্শন করবেন বলে জানা গেছে।
কৌশলগত গুরুত্ব এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাস্পিয়ান সাগর ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া, ইরান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এলাকা। সাগরটি তেল, গ্যাস ও সামুদ্রিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় এখানকার নৌ উপস্থিতি কৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে। ইরানের নতুন মহড়া সেই উপস্থিতি আরো জোরদার করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইরানের সাম্প্রতিক নৌ উদ্যোগকে অনেকেই একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক ভারসাম্যের অংশ হিসেবে দেখছেন। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার পাশাপাশি ইরান কাস্পিয়ান অঞ্চলে নিজেদের প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষাগত ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। এক কূটনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, "ইরানের এই নৌমহড়া শুধুমাত্র সামরিক কৌশলের অংশ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তাও। ইরান কাস্পিয়ান সাগরে তার স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত।"
কাস্পিয়ান সাগরে নৌবহরে নতুন জাহাজ সংযোজন, যৌথ মহড়া এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ইরান এই অঞ্চলে তার অন্যতম শক্তিশালী নৌ উপস্থিতি গড়ে তুলতে যাচ্ছে।
এমকে/টিকে