অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার ৩৬৭ ভবন, বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা!

রাজধানীসহ দেশের কোথাও বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশনসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা নড়েচড়ে বসে। দুর্ঘটনার কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করতে তড়িঘড়ি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি নানা সুপারিশ ও নির্দেশনাও দেয়। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয় না। সুপারিশ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে টালবাহানা করা হয়।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের দায় এড়ানোর প্রবণতা ও সমন্বয়হীনতায় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। এক্ষেত্রে সেবা খাতের সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে ‘একই ছাতার নিচে’ আনা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। তবে রাজউকসহ অন্যদের দাবি-বিভিন্ন দপ্তরের চাপ, জনবল সংকট ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।

সোমবার রাজধানীর বেইলি রোডে সিরাজ সেন্টারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আবার আলোচনায় অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি এসেছে।

এর আগে ২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে ২০২৪ সালে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় করা সুপারিশের মধ্যে কোনোটিই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে রাজধানীতে কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে। রাজধানীতে ২ হাজার ৬০৩টি অগ্নিঝুঁকি ভবন চিহ্নিত করে। ৫৮টি বিপণিবিতানের সবকটিই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং অতিঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া যায় ৯টি। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ফায়ার সার্ভিস বেশকিছু সুপারিশ করে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৫২টি সরকারি এবং ৯২৯টি বেসরকারি মিলিয়ে ১ হাজার ১৮১টি বহুতল ভবন (৬ তলার ওপরে) পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় ৩৬৭টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ৭৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সুপারিশ পাঠানো হলেও কেউ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, নগর সেবা দেওয়া সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। নানা টালবাহানায় সবাই দায় এড়াতে চায়। এক্ষেত্রে রাজউকের দায়বদ্ধতা বেশি। নকশা পাশ করার পর ভবন সঠিকভাবে নির্মিত হচ্ছে কি না, তা আর মনিটরিং করে না রাজউক। সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ অন্যসব সংস্থার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ফায়ার সার্ভিসের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্বীকার করে জনবল বাড়ানোসহ আইনি জটিলতা নিরসনের কথা বলেন তিনি। সেবাসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ‘একই ছাতার নিচে’ আনা গেলে সমন্বয়হীনতার সংকট দূর হবে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১২৩ জন মারা যান। ওই ঘটনায় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজধানীকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তর এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করা। ওই সময় শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও ১৫ বছরেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। গত বছর সারা দেশে ২৬ হাজার ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু এবং ৩৪১ জন দগ্ধ ও আহত হন।

আগুনের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিমতলীর ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন এবং ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় করা কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।

নিমতলীর ঘটনায় বিশেষজ্ঞ কমিটির ১৭ সুপারিশ বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর ছাড়াও সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-যাচাই-বাছাই করে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া; অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকলে ভবন মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া; নকশাবহির্ভূত কোনো অবকাঠামো তৈরি না; আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, হোটেল, রেস্টুরেন্টের গ্যাস সিলিন্ডার ভবনের নিচে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা; ভবনে আগুন সতর্কীকরণ যন্ত্র, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, পানির রিজার্ভার ও ফায়ার সামগ্রী রাখা।

রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের পর তাদের তদন্ত কমিটি অগ্নিদুর্ঘটনাসহ ঝুঁকিরোধে ছয়টি সুপারিশ করে। সেগুলোর মধ্যে ভবন ব্যবহারের সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ছাড়া কোনো ভবনে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ প্রভৃতি সেবার সংযোগ না দেওয়া। প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করা। পাঁচতলা বা তদূর্ধ্ব আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বা শিল্পকারখানার ভবনে প্রতি তিন মাস পর অগ্নিমহড়া পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা। ফায়ার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে রাজউকের ব্যবহার সনদ বাধ্যতামূলক করা এবং আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু না করা।

২০০৩ সালে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন করা হয়। এ আইনে বলা হয়-ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তির ছাড়পত্র নিতে হয়। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না-এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্র দেবে ফায়ার সার্ভিস। রাজউকে এ ছাড়পত্র দেখিয়ে ভবনের নকশার অনুমোদন নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। তবে ভবন নির্মাণের পর অধিকাংশ মালিক বা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসে আবেদন করেন না।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, কোনো ভবন পরিদর্শনের পর অগ্নিঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করে ভবন মালিকের পাশাপাশি রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ নগরসংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের জানানো হয়। অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবস্থা না নিলে চিঠি দিয়ে সতর্কও করা হয়। এ চিঠি দেওয়া ছাড়া কার্যত ফায়ার সার্ভিস আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ম্যাজিস্ট্রেসি বা দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজউক নানা দপ্তরের চাপে পড়ে। আবার ব্যবস্থা না নিলেও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। যেমন : বেইলি রোডে গ্রিন কটেজের ঘটনার পর রাজউক অভিযান চালিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মিত ভবন ও রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায়। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চাপ প্রয়োগ করে অভিযান বন্ধ করা হয়।

টিকে/টিএ

Share this news on: