২০১৮ সালে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান ৫১ জন। দুর্ঘটনার সাত বছর পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পক্ষে এল ঐতিহাসিক রায়। নেপালের কাঠমান্ডু জেলা আদালত ইউএস-বাংলাকে ২৭ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
রোববার দেওয়া রায়ে আদালত বলেছে, বিমা কোম্পানিগুলোর দেওয়া ২০ হাজার ডলারের বিমা অর্থের বাইরে এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বিমান সংস্থাটিকে।
ক্ষতিপূরণ পাবে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি পরিবার।
নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, দেশটির ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো বিমান দুর্ঘটনায় এত বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায়ের নজির তৈরি হলো। অতীতে ৭০টির বেশি বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারালেও কোনো কোম্পানিকে সরাসরি এইভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনায় ৭১ আরোহীর মধ্যে ২৮ জন বাংলাদেশি, ২২ জন নেপালি ও ১ জন চীনা নাগরিক নিহত হন।
বিমানটি ছিল ৭৬ আসনের বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০, যা ত্রিভুবনে অবতরণের সময় রানওয়ে মিস করে বিধ্বস্ত হয় এবং আগুন ধরে যায়।
নেপালের আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স গুরুতর গাফিলতি করেছে এবং উড্ডয়নের উপযোগী বিমান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে আদালত ওই ১৭ পরিবারের প্রতিটিকে পৃথকভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণে আর্থিক, মানবিক, শারীরিক ও মানসিক দিক বিবেচনা করেছে আদালত।
কার পরিবার কত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন?
⦁ সাতজন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর পরিবার: প্রত্যেকে পাবেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৮২ ডলার (প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ রুপি)।
⦁ আরও ছয় শিক্ষার্থীর পরিবার: পাবেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৮ ডলার (প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখ রুপি)।
⦁ ডা. বল কৃষ্ণ থাপার পরিবার: ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৮ ডলার (প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ রুপি)।
⦁ নার্স জিয়ানি কুমারী গুরুঙ্গের পরিবার: ৪৫ হাজার ৩০১ ডলার (প্রায় ৬২ লাখ রুপি)।
⦁ বেঁচে যাওয়া যাত্রী ডা. সামিরা ব্যঞ্জনকর: পাবেন ৪৪ হাজার ২৯০ ডলার (প্রায় ৬১ লাখ রুপি)।
প্রতিটি ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বিমা অর্থ বাদে নির্ধারিত হয়েছে। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণ বিমা অর্থ (২০ হাজার ডলার) ছাড়াও এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মামলার পেছনের গল্প
২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রথমবার ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’র অভিযোগ এনে মামলা করেন এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের পরিবার। শুরুতে ইউএস-বাংলা ৫০ হাজার ডলারে মীমাংসার প্রস্তাব দিলেও পরিবারগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াইয়ে যান। সাত বছর পর তারা পেলেন কাঙ্ক্ষিত রায়।
আদালতের নথি অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পেছনে পাইলটের মানসিক অবস্থা এবং কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনাই বড় কারণ ছিল।
এই রায়ের মাধ্যমে ১৯২৯ সালের ওয়ারশ কনভেনশন ও ১৯৫৫ সালের হেগ প্রটোকলের আওতায় ইউএস-বাংলাকে দায়ী করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের মন্ট্রিয়াল কনভেনশন এই মামলায় প্রযোজ্য হয়নি, কারণ রায়ের সময় নেপাল ও বাংলাদেশ—উভয় দেশই সেই চুক্তির সদস্য ছিল না।
আপিল করতে পারবে ইউএস-বাংলা
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র মো. কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আমাদের আইনজীবীরা নিয়ম অনুযায়ী উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।’
আইনজীবী অমৃত খারেল বলেন, 'এই রায়ে প্রমাণ হলো বিমা অর্থ ক্ষতিপূরণ নয়। বিমা টিকিটের অংশ হিসেবে যাত্রীদের অধিকার, কিন্তু অবহেলার দায়ে ক্ষতিপূরণ অবশ্যই আলাদা বিষয়।'
তিনি আরও বলেন, ‘এই রায় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করেনি, বরং এটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক বড় উদাহরণ।’
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনো বিমান সংস্থা ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা মারাত্মক গাফিলতির মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ হলে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ থাকবে।
এফপি/ টিএ