ব্যারিস্টার আরমানকে বন্দি রাখার বিষয়টি জানতাম : সাবেক আইজিপির জবানবন্দি

জুলাই আন্দোলন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় চলতি বছরের ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি। ৫ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে ২০১৮ এর ভোটে অনিয়ম, গুম, খুন ও জুলাই আন্দোলন নিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান।

জবানবন্দির এক জায়গায় চৌধুরী মামুন বলেন, কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো সাবেক সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিকি সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবকিছু অবহিত করা হতো না। ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি আছেন, বিষয়টি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন সাবেক এই শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা।

জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এই ধরনের আদেশ পাই নাই। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি। র‍্যাব যদিও পুলিশের আইজির অধীনে ছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না এবং র‍্যাবের প্রধানরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর নির্দেশে কাজ করতেন।

তিনি বলেন, আমি যতদিন র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম চেষ্টা করেছি সিরিয়াস বিষয়গুলো আইজিকে অবহিত রাখতে। টিএফআই সেলে কতজন বন্দি আসতো বা কারাবন্দি আছে এসব বিষয়ে সবকিছু আমাকে জানানো হতো না। এ বিষয়গুলো র‍্যাবের ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) দেখভাল করতেন। ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি আছে, এ বিষয়টি আমি জানতাম। তবে তাকে আমার সময় তুলে আনা হয়নি। অনেক আগে তুলে আনা হয়। আমার পূর্ববর্তী ডিজি র‍্যাব বেনজির আহমেদ দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ব্যারিস্টার আরমান যে টিএফআইতে আটক আছেন তা আমাকে অবহিত করেন।

পরবর্তীতে এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) ও ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) সরোয়ার বিন কাশেমও আরমানের আটকের বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং বন্দি করে রাখার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল। তাকে টিএফআই সেলে আটক ও গুম করে রাখার বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। এ বিষয়টি জানার পরে আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির সঙ্গে কথা বলি। তারিক সিদ্দিকি আমাকে বলেন ঠিক আছে রাখেন, বিষয়টি আপনাকে পরে বলবো। পরে তিনি আমাকে কিছুই জানায়নি। এরপরও আমি বিষয়টি কয়েকবার তারিক সিদ্দিকির কাছে উত্থাপন করি কিন্তু তিনি এ বিষয়ে আর কোনো নির্দেশনা দেননি। আমি ডিরেক্টর জেনারেল (র‌্যাব) হিসেবে দায়িত্বভার হস্তান্তরের সময় পরবর্তী ডিরেক্টর জেনারেল (র‌্যাব) খুরশিদ হোসেনকে আরমানের বিষয়টি অবহিত করি।

চৌধুরী মামুন বলেন, আমার র‍্যাবের দায়িত্বপালনকালীন যারা ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) হিসেবে কাজ করেছেন তারা হলেন- সারওয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম ও মশিউর রহমান। আমি র‍্যাবে দায়িত্বপালনকালীন টিএফআই সেলের বিনা বিচারে বন্দিদের আটক রাখা এবং নির্যাতন করা বা কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার কিছু কিছু বিষয় জানতাম কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। কারণ এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য বাহিনীর এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আসতো এবং তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করতো। এমনকি পুলিশ প্রধান হয়েও আমি র‍্যাবের এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি বা করতে পারিনি। কারণ এ বিষয়গুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করতো এবং কিছু কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির কাছ থেকে নির্দেশনা আসতো। অনেক ক্ষেত্রে আমার কথাকে গুরুত্ব দিত না।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, র‍্যাব যে সমস্ত আভিযানিক কাজ পরিচালনা করে সেগুলো অধিকাংশ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ও পরামর্শের ভিত্তিতে করে। এ ব্যাপারে আইজিপিকে প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা হতো না। র‍্যাবের আলেপ উদ্দিন এবং মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি

চিনতাম। আলেপ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবে ছিলেন, পরবর্তীতে এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) এর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তাকে র‌্যাব (ইন্টেলিজেন্স) এ পদায়ন করা হয়।

র‌্যাব (ইন্টেলিজেন্স) এ অনেক অফিসার ছিলেন। গুমসহ বিভিন্ন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আলেপের বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে র‍্যাবের অফিসাররা পছন্দ করতেন। কারণ তিনি এই কাজে পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে নিয়োজিত অফিসার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত র‍্যাবের বাকি অফিসারদের অধিকাংশই ছিল মিলিটারি অফিসার। কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো জেনারেল তারিক সিদ্দিকি সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবকিছু অবহিত করা হতো না।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বুলবুলের সঙ্গে আলোচনায় যেসব বিষয়ে কথা হয়েছে সালাউদ্দিনের Jul 31, 2025
img
ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বড় সুখবর Jul 31, 2025
img
নারী প্রতিনিধিত্বে ঐক্যমত, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব : আলী রীয়াজ Jul 31, 2025
img
জালালাবাদে শেষ হল বাংলাদেশ ও ইউএস আর্মির মধ্যকার যৌথ প্রশিক্ষণ Jul 31, 2025
img
সমগ্র দেশের মানুষ আজ সংস্কার ও বিচার চায় : নাহিদ ইসলাম Jul 31, 2025
img
ক্লাস ফেলে সমাবেশে শিক্ষার্থীরা, প্রতিবাদের মুখে এনসিপি নেতার দুঃখপ্রকাশ Jul 31, 2025
img
আমদানি পণ্য পাচারের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে আটক ৩ Jul 31, 2025
img
আ.লীগ ভারতের দালাল নয়, ভারতের সরকার : চরমোনাই পীর Jul 31, 2025
img
নতুন বাংলাদেশে নতুন সংবিধান গড়তে চায় এনসিপি : নাহিদ ইসলাম Jul 31, 2025
img
গোপালগঞ্জে ডিসির বাসভবনে হামলার ঘটনায় নতুন মামলা, আসামি ১০১ Jul 31, 2025
img
১০ আগস্ট বাংলাদেশে আসছেন পাওয়ার হিটিং কোচ জুলিয়ান উড Jul 31, 2025
img
দুই অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দিল সরকার Jul 31, 2025
img
আইএমও নির্বাচনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন কামনা করলেন নৌপরিবহণ উপদেষ্টা Jul 31, 2025
img
ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেলে ভোটের ঘোষণা দিলেন উমামা ফাতেমা Jul 31, 2025
img
মন্ত্রণালয়ের প্রচার কার্যক্রম বাড়াতে প্রধান তথ্য কর্মকর্তার আহ্বান Jul 30, 2025
img
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূরুল বাসিরকে ওএসডি, Jul 30, 2025
img
আ.লীগ নেতাদের উদ্দেশে ডিম নিক্ষেপ করতে গিয়ে ছাত্রদল নেতা আটক Jul 30, 2025
img
আগামী সংসদে এনসিপির জয়জয়কার হবে: নাহিদ ইসলাম Jul 30, 2025
বিএনপির স্মরণসভায় গিয়ে যা বললেন খন্দকার আবু আশফাক Jul 30, 2025
img
সংস্কারের দাবি উপেক্ষা করা পরবর্তী সরকারের জন্য সহজ হবে না : আসিফ নজরুল Jul 30, 2025