রাজনীতিবিদদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অঙ্গীকারই হবে বড় সংস্কার : আলী রীয়াজ

রাজনীতিবিদরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অঙ্গীকার দিলে সেটাই সবচেয়ে বড় সংস্কার হবে বলে মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘আগামীতে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যাবে। তাই ঐকমত্য কমিশনে কাগজে সই করার চেয়ে দলগুলোর অঙ্গীকার আদায় করা জরুরি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্যোগ নিতে হবে। অধিকার আদায়ে সাংবাদিকদের আন্দোলন জারি রাখতে হবে।’


রবিবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত প্রতিবেদন নিয়ে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত মতবিনিময়সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

বিজেসির চেয়ারম্যান রেজানুল হক রাজার সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজেসির নির্বাহী মিল্টন আনোয়ার। বিজেসির সদস্যসচিব ইলিয়াস হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় আরো বক্তৃতা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মিনহাজ উদ্দিন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য ফাহিম আহমেদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হাসান সোহেল, ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি সালেহ উদ্দিন, বিজেসির ট্রাস্টি তালাত মামুন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাইন খুরশীদ, বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. আল মামুন, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের মুনিমা সুলতানা প্রমূখ।

সভায় অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও চতুর্থ স্তম্ভ হওয়ার দিকটি বিবেচনা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে। সাংবাদিক ইউনিয়নকে কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। আগেই পেশাদারির জায়গা থেকে বিভিন্ন দাবি তোলা উচিত ছিল, সাংবাদিকরা তা করছেন না।

কারণ পেশাদারির জায়গায় যে অবস্থান নেওয়ার কথা সেটি সাংবাদিকরা নেননি। দাবি তোলার ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার দিকে চেয়ে থাকার প্রয়োজন নেই।’

তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের দুরবস্থার জন্য সাংবাদিক নেতৃত্ব কোনোভাবে দায় এড়াতে পারেন না। ১৬ বছর ধরে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদী সরকারকে টিকিয়ে রাখার দায় তাদের নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার আশায় দালালি করলে কোনো দিন অধিকার আদায় সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিতে অঙ্গীকার করতে হবে। নিরাপত্তা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে মালিকপক্ষ ও সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’

গড়ে উঠা মালিকানার ধরন অব্যাহত রেখে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘মালিকানার যে ধরন তৈরি হয়েছে, সেটা অব্যাহত রেখে স্বাধীন প্রফেশনাল সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। আপনি দোকানদার হবেন নাকি চতুর্থ স্তম্ভ হবেন, সেটা ঠিক করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিডিয়া ব্যবহার হচ্ছে অন্য স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। মালিকরা জানে সাংবাদিকদের বঞ্চিত করলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না। মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার জন্য রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে ওয়েজ বোর্ডের প্রশ্নটা ওঠে। অনেকে বলেছেন, ওয়েজ বোর্ড তো বাস্তবায়ন হয় না, তাহলে ওয়েজ বোর্ড করে লাভ কী? কোনো লাভ নেই। কেন হয় না ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন? কারণ, প্রতিষ্ঠানটি কোনোভাবেই ব্যাবসায়িক লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। একজন দোকানদার দোকান চালান, লাভজনক না হলে বন্ধ করে দেন। গণমাধ্যম মালিকরা লাভজনক না হওয়া সত্ত্বেও কেন গণমাধ্যম চালান? নিশ্চই একটা কারণ থাকতে হবে। এই যে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হবে কিভাবে- সেই প্রশ্নটা তুলুন।’

সরকার গণমাধ্যম কমিশনকে ফেলনা মনে করে মন্তব্য করে সহকারী অধ্যাপক মিনহাজ উদ্দীন বলেন, সরকার গণমাধ্যম কমিশনই করবে না, সম্প্রচার কমিশন তো অনেক দূরের কথা। কারণ এগুলো করলে সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। গণমাধ্যমকে সংস্কারে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সভাপতির বক্তব্যে রেজোয়ানুল হক বলেন, ‘গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রে চতুর্থ স্তম্ভ। অতীতের সরকারগুলো গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। আমরা নিজেরাই কখনো কখনো ব্যবহার করতে দিয়েছি। যত দিন এই অবস্থা থাকবে, তত দিন সরকারও ব্যবহার করতে চাইবে, আমরাও ব্যবহৃত হব। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে।’

খণ্ডিত কোনো আইন না করে গণমাধ্যমের জন্য একটি সমন্বিত আইন করার দাবি জানিয়েছে বিজেসি। সভায় মূল প্রবন্ধে মিল্টন আনোয়ার বলেন, সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষার জন্য একটি আইনের প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। কিন্তু সম্পূর্ণ কোনো আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যম পরিচালনার কথা বলেনি, যা ছাড়া কোনোভাবেই মিডিয়া পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না। তাই শ্রম আইনের আওতা থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমে কর্মরতদের জন্য একটি আলাদা আইন অপরিহার্য, যে আইনে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত সুরক্ষার বিষয়টি একসাথে থাকবে। এই আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। বিগত সরকার একটি আইনের খসড়া করলেও তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। কাজেই ওই আইন সংশোধন বা নতুন আইন করা যেতে পারে। আর গণমাধ্যমের জন্য যতদিন সমন্বিত আইন না হচ্ছে, ততদিনের জন্য শ্রম আইন সংশোধন করে সেখানে সম্প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আরো স্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে সংবাদপত্র ‘শিল্প’ হলেও সম্প্রচারমাধ্যম এখনো শিল্প হিসেবে মর্যাদা পায়নি। সম্প্রচার মাধ্যমের আর্থিক সক্ষমতা অর্জন ও জবাবদিহিতার স্বার্থে এই খাতকেও শিল্প হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করছে বিজেসি। এ ছাড়া বিজেসি মনে করে, গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রাপ্তির আগে সাংবাদিকদের বেতন ভাতা, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংস্থান ও সম্পাদকীয় নীতির মতো বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হবে এবং পরবর্তীতে সেগুলো মানা হচ্ছে কি না তা তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।

কেএন/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে স্বর্ণ Sep 03, 2025
img
আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪ কেন্দ্রীয় নেতাসহ গ্রেপ্তার ১৫ Sep 03, 2025
img
ক্ষমতার লোভে একের পর এক ভুয়া ভোট করেছিল আওয়ামী লীগ: ড. মঈন খান Sep 03, 2025
img
পিরোজপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত Sep 03, 2025
img
চীনে কিম জং উনের সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ Sep 03, 2025
img
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন-আসিয়ানকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তাব Sep 03, 2025
img
ডাকসু নির্বাচনে ছুটি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত Sep 03, 2025
img
ভিয়েতনামের কাছে হেরে অনূর্ধ্ব-২৩ এশিয়ান কাপ বাছাই শুরু করল বাংলাদেশ Sep 03, 2025
img
একক প্রার্থীকে ‘না’ ভোটের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, ইসির প্রস্তাব Sep 03, 2025
img
ফের অসুস্থ ফরিদা পারভীন, রাখা হয়েছে আইসিইউতে Sep 03, 2025
img
আপার মতো জাপাকেও ভারতে পাঠাতে হবে: রাশেদ খান Sep 03, 2025
img
খুলনায় জাতীয় পার্টির অফিসে ফের ভাঙচুর Sep 03, 2025
img
মাতারবাড়ী ও মহেশখালীকে সিঙ্গাপুর-সাংহাইয়ের মতো গড়তে চাই: আশিক চৌধুরী Sep 03, 2025
img
সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক Sep 03, 2025
img
আমি প্রতিদিনই হুমকি পাচ্ছি : মাসুদ কামাল Sep 03, 2025
img
বিসিবি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না লবী, তামিমকে সমর্থন দেবে বিএনপি Sep 03, 2025
img
শুভশ্রীকে ‘লেডি সুপারস্টার’ বলা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সহ-অভিনেতা Sep 03, 2025
img
বন্ধুর অভিনয় দেখতে স্বপরিবারে থিয়েটারে মেসি! Sep 03, 2025
img
ট্যাগিং-বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন শিবির প্যানেলের নারী প্রার্থীরা: সিবগাতুল্লাহ Sep 03, 2025
img
চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে কেন নেই নরেন্দ্র মোদি? Sep 03, 2025