নিউইয়র্কে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও’র মেহদি হাসানকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সাক্ষাৎকারের দুটো প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল। প্রসঙ্গগুলো হলো- ড. ইউনূসের বলা ‘নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে’ ও ‘আওয়ামী লীগের সমর্থক লাখ লাখ হবে না’- এ দুটো কথা। এসবের সমালোচনা করে মাসুদ কামাল বলেন, ড. ইউনূস বাঙালিদের চরিত্রই বুঝতে পারেননি।
বাঙালিরা ভয়ে কারো সমর্থন করে না। ভয়ে চুপ করে থাকে। যেমন যখন হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন, হাসিনার ভয়ে বাঙালিরা চুপ করে ছিল। তার দলের লোকেরাও চুপ করে ছিল। ভয়ে চুপ করে থাকে। ক্ষমতার কাছে ভয় পায়। ভালোবাসে মানুষটাকে, আর ভালোবাসে অসহায়কে। ভালোবাসে নির্যাতিতকে।
বুধবার (১ অক্টোবর) ‘কথা’ নামের নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এক ভিডিওতে এসব কথা বলেন তিনি। মাসুদ কামাল বলেন, উনি (ড. ইউনূস) বলতে চাচ্ছেন যে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছেন এই কারণে যে, না হলে তারা পুরো নির্বাচনটাকে বাধাগ্রস্ত করবে। মানে নির্বাচন করতে দিলে বাধাগ্রস্ত করবে। নির্বাচন না করতে দিলে বাধাগ্রস্ত করবে না?
বাংলাদেশের ইতিহাস কী বলে? ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সেই নির্বাচনে, যে নির্বাচনকে আমরা বলি অর্ধেক তারা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল, সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ইসলাম তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা কি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেনি? সেই নির্বাচনে কি সহিংসতা হয়নি? নির্বাচন করতে গেলেই বাধাগ্রস্ত করে, আর নির্বাচন না করতে দিলে বাধাগ্রস্ত করবে! ওখানে তো তারা (আওয়ামী লীগ) নির্বাচন করতে দেয়নি- তা বলা যাবে না।
তাদেরকে নির্বাচনে আহ্বান করেছিল, উনারা বুঝেছিলেন যে এটা নির্বাচন হবে না, কাজেই তারা নির্বাচনে অংশ নেননি। নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বরং বেশি হয়। উনি (ড. ইউনূস) ইলেকশন কমিশন কী মনে করে নির্বাচন করতে দিচ্ছে না, সেটা বলতে চেয়েছেন। ইলেকশন কমিশনের মনের কথা উনার জানার কথা না। কারণ ইলেকশন কমিশন তো উনার সরকারের পার্ট না। ইলেকশন কমিশন তো আলাদা একটা সাংবিধানিক একটা প্রতিষ্ঠান। তারা তো ড. ইউনূসের কাছে জবাবদিহি করে না। তাহলে এটা নিয়ে কীভাবে আলোচনা হলো? এই আলোচনাটা আমার কাছে ক্লিয়ার না।
এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আরেকটা কথা সেটা হলো উনি বলেছেন যে আওয়ামী লীগের সমর্থক লাখ লাখ হবে না। উনি বলছেন, লাখ লাখ বলব না। তবে তাদের কিছু সমর্থক আছে। লাখ লাখ হবে না আওয়ামী লীগের সমর্থক- এ কথাটা ড. ইউনূস বলতেছেন কীসের উপর ভিত্তি করে? আমি জানি না। আমি কেবল এটুকু বলব, ড. ইউনূসের আসলে বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এটা আমার আত্মবিশ্বাস। আমার যে অবজারভেশন সেখান থেকে আমি কথাটা বললাম। লাখ লাখ নয়, অনেক বেশি, অনেক লাখ সমর্থক আওয়ামী লীগের আছে। আরেকটা কথা বলেছেন। উনি সমর্থকদের ডিফাইন করেছেন। উনি বলেছেন যে তাদের সমর্থক আছে, কিন্তু কতজন অবশিষ্ট আছে- তা আমি জানি না। কারণ উনি সমর্থকের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সমর্থক এমন একটা বিষয় যে আপনি খুব ক্ষমতাধর, আমি সবসময় আপনার সামনে মাথা নত করি, কারণ আপনি ক্ষমতাধর। আমি সমর্থক হয়ে তা করছি না। মানে উনি (ড. ইউনূস) বলতে চাচ্ছেন, আমি যে আপনার সামনে মাথা নত করছি, এটা আমি সমর্থক হয়ে করছি না, আপনি ক্ষমতাধর বলে আমি এরকম একটা ভান করছি।
তিনি বলেন, আমি একটা মাত্র সিম্পল একটা উদাহরণ দিব উনাকে। একদিন আগে সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন মারা গেছেন। নরসিংদী উনার বাড়ি। উনার কোনো ক্ষমতা আছে এখন? নাই। উনার জানাজায় কত হাজার লোক হয়েছে, দেখেছেন? যেকোনো একটি পত্রিকা খুলে দেখে নেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে। দেখেন তো, উনার জানাজায় এত লোক হলো কেন? নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন কি এখনো ক্ষমতাধর? তারা (জানাজায় অংশ নেওয়া জনগণ) কি তার সামনে মাথা নত করেছে ক্ষমতার ভয়ে? বরঞ্চ উনার এখানে যাওয়ারটা অসংগত ছিল ক্ষমতার কারণে, ক্ষমতা যদি মূল ব্যাপার হয়, তাহলে তো যাওয়ার কথা না। যেমন ওই এলাকায় যিনি বিএনপির ক্যান্ডিডেট, সবসময় উনার প্রতিদ্বন্দ্বী শাখাওয়াত হোসেন বকুল, যিনি আবার হুমায়ূনের কাজিন একদিক দিয়ে, আরেকদিন আপন ভায়রাও বটে। এই ভদ্রলোক বিএনপি করেন, উনি এজন্য জানাজায় যাননি। উনার না যাওয়া সত্ত্বেও কত হাজার লোক গিয়েছে জানাজায়, একটু খেয়াল করে দেখেন। তারা কি ক্ষমতার জন্য গিয়েছে? ক্ষমতার ভয়ে গিয়েছে? না। এই জায়গাটাতে ড. ইউনূস ভুল করছেন। উনি বাঙালিদের চরিত্রই বুঝতে পারেননি। বাঙালিরা ভয়ে কারো সমর্থন করে না। ভয়ে চুপ করে থাকে। যেমন যখন হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন, হাসিনার ভয়ে বাঙালিরা চুপ করে ছিল। তার দলের লোকেরাও চুপ করে ছিল।
ভয়ে চুপ করে থাকে। ক্ষমতার কাছে ভয় পায়। ভালোবাসে মানুষটাকে, আর ভালোবাসে অসহায়কে। ভালোবাসে নির্যাতিতকে। তিনি আরো বলেন, নূরুল মজিদ হুমায়ূন যখন ক্ষমতায় ছিলেন, উনি কি ভালো করেছেন, আমি জানি না। উনি কী খারাপ করেছেন, সেটাও আমি জানি না। আমার সঙ্গে উনার ক্ষমতায় থাকার সময় কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন, খারাপ করতেই পারেন, দুর্নীতি করতেও পারেন, বিচার হতেই পারে- আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু আমার কথা হলো, যখন উনি বন্দি, তখন তার সঙ্গে যে আচরণটা করা হয়েছে, মৃত্যুর পরেও তার হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল। এই যে ঘটনাগুলো- মানুষের মনে তার প্রতি এক ধরনের সমবেদনা তৈরি করেছে এবং তারই প্রতিফলন তার জানাজায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতি। আমি একটা হাইপোথেটিক্যাল কথা বলি।
উনি যদি ক্ষমতায় থাকাকালীন মন্ত্রী হিসেবে মৃত্যুবরণ করতেন, তাহলে যদি এত লোক হতো, তখন আপনি বলতে পারতেন, এই লোকগুলো ভয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন তো উনি কেউ না। নো বডি। এখন উনি এমন একজন লোক, যার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাধারণ বেডে মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সময় তার হাতে হাতকড়া ছিল। তাকে একজন মন্দ লোক আপনারা বলতে চাচ্ছেন? এই সরকার তাকে মন্দ লোক এবং অগুরুত্বপূর্ণ লোক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সেই মন্দ এবং অগুরুত্বপূর্ণ লোকটার জানাজায় এত লোক হলো কেন? ভয়ে? ড. ইউনূসকে বুঝতে হবে, সমর্থনটা কোথা থেকে আসে। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় এরকম এত উন্মুক্ত যে তারা এই ধরনের নির্যাতিত মানুষকে সমর্থন করে। নির্যাতিত মানুষকে ভালোবাসে।
এসএস/এসএন