রোহিঙ্গা নারীদের ৯৭ শতাংশই শিক্ষার বাইরে জানিয়েছে বৈশ্বিক প্রতিনিধিদল

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে ক্যাম্প পর্যবেক্ষণ করা বৈশ্বিক একটি প্রতিনিধিদল। তারা বলছে, শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ায় বিশেষ করে মেয়েদের জন্য আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাদের জরিপের তথ্য বলছে, রোহিঙ্গা নারীদের প্রায় ৯৭ শতাংশই এখনও শিক্ষার বাইরে, যা মানবিক শিক্ষা উদ্যোগের জন্য বড় এক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একটি সুসংহত, স্বীকৃত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কাঠামো গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে জাস্টিস ফর অলের নেতৃত্বাধীন বার্মা টাস্ক ফোর্স প্রতিনিধিদল।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ঢাকার গোল্ডেন টিউলিপ দ্য গ্র্যান্ডমার্ক হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এ আহ্বান জানান। 

প্রতিনিধিদলটি বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নীতিনির্ধারণ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে বহু বছরের গবেষণা ও সাম্প্রতিক মাঠ পরিদর্শনের ভিত্তিতে মূল সুপারিশগুলো তুলে ধরেন।

প্রতিনিধিদলের অনুসন্ধানটি ১,০০০ রোহিঙ্গা নারীর ওপর করা জরিপ, শিক্ষাবিদ ও প্রশাসকদের সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শ এবং শিবিরভিত্তিক স্কুল পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে। এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা স্কুল-যুগের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ নারী হলেও তাদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশই শিক্ষার আওতায়।

তাদের আনুষ্ঠানিক স্মারকলিপিতে তিনটি পদক্ষেপের ওপর জোর দেওয়া হয়–

১. রোহিঙ্গা শিক্ষার জন্য একটি একীভূত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন; 
২. একটি স্বীকৃত সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা গঠন, যা উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পথ খুলে দেবে; 
৩. মার্কিন মুসলিম ত্রাণ সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি, যাতে বিপুল দাতব্য সম্পদ ও দক্ষতা কাজে লাগানো যায়।

জাস্টিস ফর অলের সভাপতি ও বার্মা টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ইমাম আবদুল মালিক মুজাহিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছে, তা বিশ্বের আর কোনো দেশ দেখায়নি। এখন সময় এসেছে– একটি স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যেন রোহিঙ্গা শিশু, বিশেষ করে মেয়েরা, তাদের ভবিষ্যৎ থেকে বঞ্চিত যেন না হয়।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গা শিক্ষা কার্যক্রমের অর্থায়নে বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে এই খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ বা তার বেশি অর্থ বিদেশ থেকে আসত, এখন যুক্তরাষ্ট্র ইউনিসেফকে অর্থায়ন করবে, যারা বর্তমানে পুরো ৭৫ শতাংশ শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করছে।’

তিনি জানান, আগে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, যার ফলে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল।

‘আমরা যখন পরিদর্শনে যাই, দেখি– অসংখ্য শিশু আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শেখার কোনো জায়গা নেই তাদের জন্য। এখন শেখার অনুমতি পাওয়া বড় একটি অগ্রগতি।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এই অনুমতির বাস্তব প্রয়োগে পর্যাপ্ত অর্থায়ন অপরিহার্য। ‘মুসলিম দেশসমূহ, বিশ্ব ব্যাংক, ইউরোপীয় দেশ ও আমেরিকা সবাই যদি এই উদ্যোগে আরও অর্থায়ন করে, তবে শিক্ষার মান ও সুযোগ—দুটোই উন্নত হবে।’

মুজাহিদ আরও বলেন, রোহিঙ্গা অভিভাবকদের অনেকেই মনে করেন ইউনিসেফ পরিচালিত স্কুলগুলো সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত নয়। এই কারণে ইউনিসেফ স্কুলগুলোর প্রতি তাদের অনুমোদন মাত্র ২৩ শতাংশ। তারা চায় শিক্ষা ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনা ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা প্রতিফলিত হোক।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের সাবেক চেয়ার নাদিন মানজা বলেন, ‘কক্সবাজারে আমি এমন পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করেছি যারা জানে, শিক্ষাই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। শিবিরে শিক্ষা প্রদান কেবল মানবিকতার কাজ নয়– এটি কৌশলগত বিনিয়োগ। অশিক্ষিত প্রজন্ম নির্ভরতা ও অনিরাপত্তা বাড়াবে, কিন্তু শিক্ষিত প্রজন্ম শান্তি, স্থিতিশীলতা ও বাংলাদেশ-বার্মা উভয় দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ভূমিকা রাখবে।’

তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের শিক্ষা পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং সত্যিই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫০০,০০০ স্কুলগামী শিশুর মধ্যে ৩৪০,০০০ জন পূর্বে স্কুলে ছিল, কিন্তু এখন ছেলে-মেয়ে উভয়েই ক্যাম্পের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারণ তাদের খেলাধুলা বা শিক্ষার কোনো জায়গা নেই। ছোট রাস্তা, ছোট কুঁড়েঘর– শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়।’

নাদিন মানজা আরও বলেন, নীতি অস্পষ্ট এবং অর্থায়ন বন্ধ থাকার কারণে চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত অধিকাংশ স্কুল বন্ধ। এছাড়াও শিক্ষার অভাবে গ্যাং বা অপরাধমূলক কার্যকলাপে ঝুঁকি বাড়ছে। সেইসঙ্গে কিছু রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক নিজস্ব কুঁড়েঘরে অল্প পরিসরে পড়াচ্ছেন, কিন্তু সুবিধা নেই। দীর্ঘদিন নীতি অনুসারে শিক্ষা শুধু চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সীমিত ছিল, যা কোনো বাস্তব মান বহন করে না।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মুখপাত্র রিচার্ড রিওচ যোগ করেন, ‘শিক্ষা হলো গণহত্যার ভয়াবহতার মধ্যে বন্দি তরুণদের পুনরুদ্ধারের জীবনরক্ষাকারী পথ। যেভাবে তাদের খাদ্য ও পানির প্রয়োজন, ঠিক তেমনই প্রয়োজন শিক্ষা থেকে পাওয়া মানসিক যত্ন ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ। আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গা শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিবেদনই প্রমাণ করে– গণহত্যাও তাদের সন্তানের শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা নিভিয়ে দিতে পারেনি।’

প্রতিনিধিদল বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানায় শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের দপ্তরকে, উন্মুক্ত সংলাপ ও মাঠ পরিদর্শনে সহযোগিতার জন্য। কমিশনার মিজানুর রহমানের প্রশংসা করে তারা বলেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা, জাতিসংঘ সংস্থা ও এনজিওগুলোর সঙ্গে তিনি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের নতুন পথ অনুসন্ধানে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন।

আরপি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের ব্যাখ্যা দিল সরকার Nov 05, 2025
img

নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী

ড. ইউনূসের সঙ্গে ডিল করে ক্ষমতায় গেলে এনসিপির হাতে বিএনপির পতন হবে Nov 05, 2025
img
জাকির নায়েককে আপাতত বাংলাদেশে আসার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত Nov 05, 2025
img
রাতে অ্যানফিল্ডে মাঠে নামছে লিভারপুল ও রিয়াল মাদ্রিদ Nov 05, 2025
img
বিপিএলের ৫ দল চূড়ান্ত, থাকছে না বরিশাল Nov 05, 2025
img
আওয়ামী লীগ ফিরবে, সেটা সময়ের ব্যাপার, কিন্তু কীভাবে ফিরবে? Nov 04, 2025
img
মনিরুল হক চৌধুরীকে সর্বোচ্চ ভোটে পাশ করাবো: সাক্কু Nov 04, 2025
img
দুই মাসের মধ্যে সব ক্যাম্পাসে নির্বাচন দিতে হবে: ডাকসু ভিপি Nov 04, 2025
img
বড়দিনে দর্শকের জন্য চমক নিয়ে আসছে কার্তিক-অনন্যা Nov 04, 2025
img
কোহলিকে পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়লেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটার Nov 04, 2025
img
জন্মদিনে মৌসুমীকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট ওমর সানীর Nov 04, 2025
img
শাহজালালে হচ্ছে অত্যাধুনিক চারতলা কার্গো ভিলেজ Nov 04, 2025
img
যারা নতুন করে রাজনীতি করতে চান, যোগাযোগ করুন : ভিডিও বার্তায় নাহিদ Nov 04, 2025
img
রাশমিকা মান্দানা অবশেষে দেখালেন বাগদানের আংটি Nov 04, 2025
img
কোচ আসলেও এখনো ক্যাম্পে আসেননি কিংসের ফুটবলাররা Nov 04, 2025
img
বিএনপিতে যোগ দিলেন শহীদ মীর মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধ Nov 04, 2025
img
বাংলাদেশের সঙ্গে পাওনা নিয়ে বিরোধ, আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাচ্ছে আদানি Nov 04, 2025
img
এনসিপি সরকার গঠন করলে বিএনপিকেও বিচারের সম্মুখীন করা হবে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী Nov 04, 2025
img
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত Nov 04, 2025
img
নভেম্বরের ৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এলো ৩৫ কোটি ডলার Nov 04, 2025