গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত ১ লাখ মানুষ, বলছে জার্মান গবেষণা

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় টানা দুই বছর ধরে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। বর্বর এই আগ্রাসনে নিহত হয়েছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য।

মূলত জার্মান এই গবেষণায় সরকারি পরিসংখ্যানের বাইরে উঠে এসেছে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির চিত্র। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।

বার্তাসংস্থাটি বলছে, গাজায় চলমান যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা এতদিন যা ধারণা করা হচ্ছিল, বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে সোমবার জার্মান সাপ্তাহিক পত্রিকা জাইট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জার্মানির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী রস্টকের খ্যাতনামা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোগ্রাফিক রিসার্চের একদল গবেষকের হিসাব অনুযায়ী, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ যুদ্ধে অন্তত এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বা নিহত হয়েছে।

গবেষণা প্রকল্পটির কো-লিডার ইরিনা চেন জানান, “সঠিক মৃতের সংখ্যা আমরা কখনোই জানতে পারব না। আমরা শুধু যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত একটি অনুমান করতে চেষ্টা করছি।”

গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে গাজা উপত্যকায় ৯৯ হাজার ৯৯৭ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯১৫ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বা তারা নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যবর্তী বা গড় অনুমান ১ লাখ ১২ হাজার ৬৯ জন।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের গবেষকরা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পরিসংখ্যানগত এই চিত্র তৈরি করেছেন। গাজাভিত্তিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের পাশাপাশি তারা একটি স্বাধীন পরিবারভিত্তিক সমীক্ষা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত মৃত্যুসংবাদও এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এতদিন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যার একমাত্র সরকারি উৎস ছিল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে তারা ৬৭ হাজার ১৭৩ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। তবে জাইট–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই তথ্য নিয়ে কোনো ধরনের পরিসংখ্যানগত কারসাজির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উল্টো বিভিন্ন গবেষণা দল আগেই দেখিয়েছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাধারণত রক্ষণশীলভাবে হিসাব করে থাকে। এখন ভালোভাবেই নথিভুক্ত হয়েছে যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে সরকারি সংখ্যার চেয়ে বাস্তবে আরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। বিভিন্ন গবেষণাতেই অপ্রকাশিত মৃত্যুর সংখ্যা যে বেশি, তা বারবার উঠে এসেছে।

এছাড়া গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেবল নিশ্চিত মৃত্যুর তথ্যগুলোই গণনা করে— যেমন হাসপাতাল থেকে ইস্যুকৃত মৃত্যু সনদের ভিত্তিতে। যুদ্ধের কারণে অনেক হাসপাতালে স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তারা স্বজনদের দেওয়া মৃত্যুসংবাদও গ্রহণ করে; পরে একটি প্যানেল সেগুলো যাচাই করে। বোমায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে যারা মারা যান, তাদের অনেকেই এসব রেকর্ডে ধরা পড়ে না।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের এই গকেষণা দলটি আগের গবেষণার ভিত্তিতে আরও বিস্তারিত মৃত্যুহার বিশ্লেষণ করেছে। তারা পুরুষ ও নারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সভিত্তিক হিসাব আলাদাভাবে পরীক্ষা করেছে।

এ পদ্ধতিতে শুধু মোট মৃত্যুর সংখ্যা আরও নির্ভুলভাবে জানা যায় না, বরং কারা মারা গেছে— তা নিয়েও বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায়। লিঙ্গ ও বয়সভেদে মৃত্যুর রেকর্ডের তথ্য পরিবর্তিত হয়; নারীদের মৃত্যু অনেক সময় পুরুষদের তুলনায় কম নথিবদ্ধ হয়। ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যু প্রায়ই সরকারি হিসাব থেকে বাদ পড়ে যায়।

গবেষকদের হিসাবে, মৃতদের প্রায় ২৭ শতাংশই ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু এবং প্রায় ২৪ শতাংশ নারী।

এছাড়া গবেষকরা যুদ্ধের কারণে গাজার জীবনযাত্রার ওপর প্রভাবও হিসাব করেছেন। যুদ্ধের আগে গাজায় নারীদের গড় আয়ু ছিল ৭৭ বছর, পুরুষদের ৭৪ বছর। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী নারীদের জন্য এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ বছরে এবং পুরুষদের জন্য ৩৬ বছরে। এটি আপাতত একটি পরিসংখ্যানগত মান।

এর অর্থ হলো— যদি সাম্প্রতিক বছরের মতো একই মাত্রায় যুদ্ধ চলতে থাকে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা গড়ে এই বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পারবেন। আর এসব পরিসংখ্যানই দেখাচ্ছে, গাজার সাধারণ মানুষের জীবনের ঝুঁকি কতটা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে।

ইএ/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিজয়ের ৫৪ বছরে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি কম : ধর্ম উপদেষ্টা Dec 16, 2025
img

প্রধান উপদেষ্টা

১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি চূড়ান্ত Dec 16, 2025
img
তারেক রহমানের জন্য প্রস্তুত বাসভবন ও অফিস Dec 16, 2025
img
হাসিনা-কামালকে দেশে ফেরাতে আইনি প্রক্রিয়া চলছে: প্রধান উপদেষ্টা Dec 16, 2025
img
হাদিকে উপর হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত সেই মোটরসাইকেলের প্রকৃত মালিকের তথ্য দিলেন কবির Dec 16, 2025
img
তরুণ প্রজন্ম ভিনদেশিদের দাদাগিরি মেনে নেয়নি, নেবে না : মুজিবুর রহমান Dec 16, 2025
img

প্রধান উপদেষ্টা

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিতে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার Dec 16, 2025
img
সিডনিতে বন্দুক হামলা চালানো যুবক ভারতীয় নাগরিক Dec 16, 2025
img
বাংলাদেশে সহিংস রাজনীতির সংস্কৃতির কোনো জায়গা নেই : রিজওয়ানা হাসান Dec 16, 2025
img
বলিউডের স্পাই সিনেমা ‘ধুরন্ধর’ জন্ম দিল ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক বিতর্কের Dec 16, 2025
img
কারিনা সংসারটাকে আগলে রেখেছে : সাইফ Dec 16, 2025
img
হাদিকে হামলার ঘটনায় ফয়সালের সহযোগী কবির ৭ দিনের রিমান্ডে Dec 16, 2025
img
হাদির সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানাল ইনকিলাব মঞ্চ Dec 16, 2025
img

ওসমান হাদির ওপর হামলা

ষড়যন্ত্রে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না : প্রধান উপদেষ্টা Dec 16, 2025
img
হাদির আরও একটি সার্জারি প্রয়োজন, তবে প্রস্তুত নয় শরীর Dec 16, 2025
img
নারী চিকিৎসকের নিকাব টেনে খুললেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধীদের নিন্দা Dec 16, 2025
img
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এড়িয়ে সীমান্ত রক্ষা’র কথা বললেন রাহুল গান্ধী Dec 16, 2025
img
প্রথমবারের মতো 'বিগ ব্যাশে' রিশাদের দারুণ অভিষেক Dec 16, 2025
img
প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন : এ্যানি Dec 16, 2025
img
১৮ কোটিতে পাথিরানাকে দলে নিল কলকাতা Dec 16, 2025