আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গণশুনানির দাবি বেরোবি শিক্ষার্থীদের

চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গণশুনানির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, গণশুনানি কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াই চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে, যা ভিত্তিহীন ও মনগড়া।

শনিবার (২৮ জুন) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। কর্মসূচি থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে দেওয়া আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার্জশিট প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা, খাদিজা আক্তার, নুরুন্নবী আফরিনসহ অন্যরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক রাফিউল আজিম, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক আব্দুল লতিফ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী উম্মে জেবিনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

বক্তারা বলেন, পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ শহীদ হয়েছে। এ মামলার মূল আসামিরা এখনো পলাতক রয়েছে। ঢাকায় বসেই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা আবু সাইদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তারা শহীদ আবু সাঈদের সহপাঠী, আন্দোলনের সহযোদ্ধা কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেননি। এমনকি কোনো গণশুনানিও হয়নি।

আন্দোলনকারীরা আরও বলেন, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে রয়েছে। আর সাজা পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আমরা চাই এই মামলায় যার যতটুকু অপরাধ, তাকে ততটুকু সাজা দেয়া হোক। কেউ যেন লঘু অপরাধে গুরুদন্ড না পায়।

বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামকে আবু সাঈদ হত্যা মামলার ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশকে বেরোবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চার্জশিটে বলা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। ট্রাইব্যুনাল তড়িঘড়ি করে বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে তারা আবু সাঈদ হত্যার বিচার করছে। অথচ অনেক আসামি এখনো বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। মূল অপরাধীদের আড়াল করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

তারা তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নতুনভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত ও গণশুনানি আয়োজনসহ প্রকৃত হত্যাকারীদের দ্রত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কী বলেছে, সেটা আমি এখনো জানি না। তবে চার্জশিট দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি ছিল বলে আমি মনে করি।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন আবু সাঈদ। ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। পরদিন ১৭ জুলাই তাকে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ও ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন আবু সাঈদ।

ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হয় বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।

ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এ ঘটনায় ১৮ আগস্ট ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী।

আসামিরা হলেন- সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান, সহকারী পুলিশ কমিশনার ইমরান হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান ও আসাদুজ্জামান মণ্ডল, কর্মকর্তা রাফিউল হাসান, বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বিভূতিভূষণ, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহফুজ, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার টগর ও দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, তাজহাট থানার এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র। এই হত্যা মামলায় আসামির তালিকায় নতুন আরও ৭ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাদী রমজান আলীর দায়ের করা হত্যা মামলায় ১৪ অক্টোবর আদালতে আবেদন করা হলে দাখিলকৃত ছবি ও সিসি টিভি ফুটেজ জব্দ করে ও গ্রহণের আদেশ দেন আদালত। নতুন সাত আসামির মধ্যে রয়েছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হাসিবুর রশিদ, সাবেক প্রক্টর ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা শাখা) শাহ নূর আলম পাটোয়ারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নূরুন্নবী, সুরতহাল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা এসআই তরিকুল ইসলাম ও সুরতাহাল রিপোর্টের প্রতিস্বাক্ষরকারী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাত।

এর আগে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরদিন ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা হয়। মামলার বাদী ওই থানার উপপরিদর্শক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতিভূষণ রায়। মামলার এফআইআরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না।

সেখানে বলা হয়, ‘বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ি থেকে সরকারি ইস্যুকৃত শর্টগান থেকে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।’

আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২/৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।’

এদিকে আবু সাঈদ হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে প্রথমে মামলাটি পিবিআইর কাছে স্থানান্তর করা হয়।

পিবিআই রংপুরের পুলিশ সুপার এবিএম জাকির হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ওই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তারসহ রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞসাবাদ করা হয়। পরে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গেলে ট্রাইব্যুনাল ওই চারজনকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছেন। এখন ওই মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে মামলা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সবগুলো নথি সরবরাহ করা হবে।

এফপি/এস এন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
স্বামী নয় প্রভু, স্ত্রী হতে পারে শ্রেষ্ঠ বন্ধু: স্বতন্ত্র চিরসখা Nov 07, 2025
"ঘি আমাদের লাগবেই" জামায়াত নেতা তাহেরের বক্তব্যে রিজভী যা বললেন | Nov 07, 2025
বিএনপি রাস্তায় নামলে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নেবে: বিএনপি মহাসচিব Nov 07, 2025
‘নো হ্যাংকি প্যাংকি’, বিএনপিকে জামায়াতের হুঁশিয়ারি Nov 07, 2025
যে কারণে তিস্তা ব্যারেজ ও নিজ গ্রামের ইতিহাস টানলেন রিজভী Nov 07, 2025
চরফ্যাশনে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন নুরুল ইসলাম নয়ন Nov 07, 2025
''মাদকমুক্ত এলাকা গড়ে তুলব'' Nov 07, 2025
ডর-এ রাভিনার না হওয়া চরিত্রের অজানা গল্প Nov 07, 2025
img
ডি ককের সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানকে হারিয়ে সমতায় ফিরলো দক্ষিণ আফ্রিকা Nov 07, 2025
img
রাজনীতিতে ইশরাককে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব: নুসরাত খান Nov 07, 2025
img
নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে: দুলু Nov 07, 2025
img
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক সম্পন্ন Nov 07, 2025
img
২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভেন্যুর সংক্ষিপ্ত তালিকা চূড়ান্ত Nov 07, 2025
img
দিল্লি নয়, ঢাকা থেকেই করা যাবে বেলজিয়ামের ভিসা আবেদন Nov 07, 2025
img
জাহানারার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করছে বিসিবি Nov 07, 2025
img
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আর নেই Nov 07, 2025
img
ধাক্কা খাওয়া ভয়ের নয়, অভিজ্ঞতা: শুভশ্রী গাঙ্গুলী Nov 07, 2025
img
নরসিংদীতে ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা Nov 07, 2025
img
মির্জা ফখরুলকে জামায়াতের নায়েবে আমীরের কল Nov 07, 2025
img

ঐকমত্য কমিশনের ব্যয় নিয়ে মিথ্যাচারের প্রতিবাদ

ঐকমত্য কমিশনের মোট ব্যয় ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, আপ্যায়ন খাতে ৪৫ লাখ Nov 07, 2025