দক্ষিণ কোরিয়ায় বাড়ছে আত্মহননের প্রবণতা, দিনে প্রায় ৪০

দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত প্রযুক্তি, কে-পপ এবং কে-ড্রামা দিয়ে বিশ্বকে প্রভাবিত করে। এমন একটি গতিশীল, প্রাণবন্ত দেশের ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আত্মহত্যা, মদ্যপান, উদ্বেগ এবং হতাশার হার সর্বোচ্চ দক্ষিণ কোরিয়ায়। এই সামাজিক ব্যাধিগুলো ধীরে ধীরে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে কোরিয়ার তরুণ প্রজন্মকে।

‘কোরিয়া ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড’-এর প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে মোট ১৪ হাজার ৪৩৯টি আত্মহত্যার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল। দৈনিক গড়ের হিসাবে যা ৩৯.৫টি। তথ্য আরো বলছে, ২০২৪ সালে প্রতি ১ লক্ষ কোরীয় অধিবাসীদের মধ্যে ২৮.৩ জন আত্মহত্যা করেছেন।

সামাজিক ব্যাধির এই সংক্রমণের জন্য কোরিয়ান শিক্ষাব্যবস্থাও বড় অংশে দায়ী বলে মনে করা হয়।

প্রাথমিক স্কুলগুলোতেই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে শিশুদের শিক্ষাদান শুরু হয়। কোরীয় শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি এতটাই কঠোর যে, মাত্র চার বছর বয়সে প্রাথমিক বি‌ভাগেই প্রবন্ধ লেখায় হাত পাকানো শুরু করতে হয়। মাত্র ১৫ মিনিটে বড় বড় প্রবন্ধ লেখার কৌশল আয়ত্ত করতে হয় পড়ুয়াদের। এই বয়সে অন্যান্য দেশে ভালোভাবে কলম বা পেনসিল ধরতেই পারে না পড়ুয়ারা।

প্রতিযোগিতায় শামিল করার জন্য ওই বয়সেই তাদের স্কুলশিক্ষার পাশাপাশি বাইরে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়তে পাঠানো হয়। অঙ্ক, ইংরেজি, সাহিত্যের পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্পকলাতেও দক্ষ করে তুলতে কোরীয় বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েকে এই গড্ডালিকা প্রবাহে ঠেলে দেন। তাদের এমন পাঠ দেওয়া হয় যাতে তাদের মনে ‘সব কিছু পেতেই হবে’ এমন একটি প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় শৈশবেই।

কোরীয় পড়ুয়াদের মধ্যে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়ার প্রচলন এতটাই বেশি যে, প্রাথমিক বি‌ভাগের পাশাপাশি হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর মধ্যরাত পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

অভিভাবকেরা ‘প্রাইভেট টিউশন’কে সন্তানের জন্য বিনিয়োগ বলে ধরে নেন।তারা ধরে নেন এটিই সন্তানের ভবিষ্যতের ভিত্তি।

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা তাদের রোজগারের ৩০ শতাংশ ব্যয় করেন তাদের সন্তানের গৃহশিক্ষকদের জন্য। আর এইভাবেই দক্ষিণ কোরিয়ায় গৃহশিক্ষকতার ‘বাজার’ লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।

অত্যধিক প্রতিযোগিতার অভিশাপ ফলতে শুরু করে দিয়েছে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে। দক্ষিণ কোরিয়ার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা মানসিক অসুস্থতার রূপ নিচ্ছে। ফলস্বরূপ বাড়ছে আত্মহত্যার পরিমাণ। ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে একটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার সংখ্যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

যে হারে তরুণ প্রজন্ম অসুস্থ প্রতিযোগিতা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তাতে ২০৬০ সালে দেশটিতে শুধু বৃদ্ধরাই বেঁচে থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এমনিতেই দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার খুবই কম। জীবনযাত্রার জটিল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তান জন্ম না দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গড় জন্মহারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে সে দেশে।

যেসব দেশে কয়েক দশক ধরে নবজাতকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে তাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বব্যাপী সমস্ত উন্নত দেশগুলোতে জন্মের হার কমতে দেখা গিয়েছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চরম সংকটের মুখোমুখি নয় কোনো দেশই।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশটির জন্মহার এতটাই নেমে গিয়েছে যে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মোট প্রজননের হার (একজন মহিলার প্রজনন বয়সে গড় সন্তানের সংখ্যা) দাঁড়িয়েছে ০.৭২।

২০২২ সালে এই গড় ছিল ০.৮১। একটি দেশের সুস্থ ও স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য এই গড়ের প্রয়োজনীয় মান হলো ২.১। অর্থাৎ, একজন দক্ষিণ কোরীয় তরুণীকে কমপক্ষে দু’জন শিশুর জন্ম দিতে হবে।

কমতে কমতে এখন জন্মহার এসে দাঁড়িয়েছে ০.৭ শতাংশে, যা সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তরুণ প্রজন্মের দম্পতিরা এক জন শিশুরও জন্ম দিতে নারাজ।

দক্ষিণ কোরিয়া আসলে আদ্যন্ত বর্ণবাদী দেশ। চামড়ার রং থেকে শুরু করে মুখের গড়ন, বাহ্যিক সৌন্দর্যই কোরীয় সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় বাহ্যিক সৌন্দর্যকে এতটাই প্রাধান্য দেওয়া হয় যে, কলেজ পাস করার পর ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে উপহার হিসাবে পান প্লাস্টিক সার্জারির খরচ। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেদের আরও ‘সুন্দর’ করে তোলেন তাঁরা। সে দেশে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন তরুণী প্লাস্টিক সার্জারি করান।

দেশের বিভিন্ন সংস্থায় চাকরির ইন্টারভিউতেও সৌন্দর্যকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কে কত সুন্দর দেখতে, কার গায়ের রং কতটা উজ্জ্বল এবং ফর্সা, তার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়। সৌন্দর্য এবং বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য কোরিয়ার চাকরির বাজারে এক সময় এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, নিয়োগ নিশ্চিত করার আগে কোনো কর্মচারীর মুখ না দেখার নিয়ম চালু হয়েছিল বেশ কিছু সংস্থায়।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশটি উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করার জন্য পরিচিত। ২০২১ সালে, দক্ষিণ কোরীয়রা বছরে গড়ে ১,৯১৫ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন। নির্দিষ্ট মাপকাঠির চেয়ে প্রায় ২০০ ঘণ্টা বেশি। অতিরিক্ত কাজের চাপ প্রভাব ফেলেছে ব্যক্তিগত জীবনেও।

ন্যাশনাল হেল্‌থ ইনশিয়োর্যান্স সার্ভিসের গবেষণা বলছে, শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের কারণে অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানকার তরুণ-তরুণীরাও। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গাউট এবং আর্থ্রাইটিসের মতো রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরআর/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাসারাঙ্গাকে সামলানোর নতুন কৌশল খুঁজে পেল বাংলাদেশ! Jul 05, 2025
img
সংস্কার শেষে এই সংবিধানের অধীনেই দেশ চলবে: রিজভী Jul 04, 2025
img
আওয়ামী লীগ শুধু হিন্দুদের ব্যবহার করেছে মাত্র: আযম খান Jul 04, 2025
img
আগস্টে তুরস্কের বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ নারী দল! Jul 04, 2025
img
ধূমপানের দৃশ্য নয়, নীতির কাছে আপসহীন অভিনেত্রী রাশমিকা! Jul 04, 2025
img
খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক তুলে নিল রাজস্ব বোর্ড Jul 04, 2025
img
বিএনপি জনগণের রাজনীতি করে, ক্ষমতার রাজনীতি করে না: ওবায়দুর রহমান চন্দন Jul 04, 2025
img
‘রামায়ণ’ হতে যাচ্ছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা Jul 04, 2025
img
দেশে টানা ৫ দিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস Jul 04, 2025
১০ মিনিটে সারাদিনের দেশের আলোচিত সব খবর Jul 04, 2025
img
সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে না পারা : শিবির সভাপতি Jul 04, 2025
img
জুলাই যোদ্ধাদের সনদ দেওয়া সম্ভব কিন্তু একটু ক‌ঠিন : উপদেষ্টা শারমীন Jul 04, 2025
img
অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় উন্মাদনা ছড়াচ্ছে ‘ওয়ার ২: প্রথম শো ভোর পাঁচটায় Jul 04, 2025
img
ভারতের আধিপত্য রুখতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে : আব্দুস সালাম Jul 04, 2025
img
মন্দোদরী চরিত্রে পা রাখছেন কাজল? Jul 04, 2025
img
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও 'কঙ্গুভা ২' -এর দাবি ফ্যানদের Jul 04, 2025
img
যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে লেবাননে ফের হামলা চালাল ইসরায়েল Jul 04, 2025
img
পাকিস্তানের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সাবেক কোচ Jul 04, 2025
img
চুয়াডাঙ্গায় ট্রাক চাপায় নিহত ৩ Jul 04, 2025
img
‘আখণ্ড ২’তে কেন্দ্রীয় চরিত্রে বজরঙ্গি’র মুন্নি Jul 04, 2025