দ্বিপক্ষীয় সফরে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় আসছেন। এ সফরে কয়েকটি চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামাবাদের লক্ষ্য থাকবে— এ সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বার্তা দেওয়া। সরকারের এক কূটনীতিক বলছেন, এপ্রিল মাসের স্থগিত সফরটা এখন হবে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে উভয়পক্ষের সম্মতি আছে। সম্ভবত আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে সফরটা হবে। এজন্য কাজ চলছে।
ইসলামাবাদের নির্ভরযোগ্য একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ২২ বা ২৩ আগস্টে ঢাকা সফরে আসার কথা রয়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল ইসহাক দারের ঢাকা আসার কথা ছিল। তবে ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে দেশটির সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলে দারের ঢাকা সফর স্থগিত করে ইসলামাবাদ। এ প্রসঙ্গে সরকারের ওই কূটনীতিক বলেন, সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তখন পাকিস্তান না করেছিল। প্রায় সবকিছু প্রস্তুত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা সফরকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মূল বৈঠক হবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। এ ছাড়া ইসহাক দারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফাঁকে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ইসহাক দারের সাক্ষাৎ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বছরের ব্যবধানে এটি ছিল তার চতুর্থ সাক্ষাৎ। ওই সাক্ষাতে দারের ঢাকা সফর নিয়ে আলোচনা হয়। সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন এমন এক কূটনীতিক জানান, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রসঙ্গটি এসেছে। ইসহাক দার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের পরপরই ঢাকা সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেই সাক্ষাতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সহজ করার কথা জানিয়ে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর কথা বলেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরে কয়েকটি চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এক কূটনীতিক বলেন, সফর নিয়ে কাজ প্রায় শেষ করা আছে। আগে কিছু অ্যাগ্রিমেন্ট হয়ত আলোচনায় ছিল না, এখন হয়ত আলোচনায় আসতে পারে; কিছু অগ্রগতিও আছে। এখনই ঠিক বলা যাবে না কয়টি চুক্তি হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ পর স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে বেশ আগ্রহী ইসলামাবাদ। তারই অংশ হিসেবে দীর্ঘ ১৫ বছর পর গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান, বৈঠকে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ।
২৭-২৮ এপ্রিল দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের। তবে ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে দেশটির সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলে দারের ঢাকা সফর স্থগিত করা হয়।
কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহের কারণে মনে হয়েছে দুই দেশ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্কে যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, সেটিও দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। প্রথমে নিউইয়র্ক ও পরে মিশরে। প্রথম সাক্ষাতে ড. ইউনূস একাত্তরের প্রসঙ্গ না তোলায় দেশের অনেকে নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন। তবে, মিশরে একাত্তরের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বেশকিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুই দেশের মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে, যে সুযোগ আগে ছিল না। গত ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের ভিসাপ্রাপ্তি সহজ করার নির্দেশ দেয়। আগে পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত উন্নত দেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র লাগত। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানের ভিসার চার্জ লাগবে না। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচলের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে চারবার সাক্ষাৎ করেছেন। এ ছাড়া তাদের মধ্যে টেলিফোনেও আলাপ হয়েছে। গত মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) প্রধান হিসেবে ঢাকা সফর করেছেন।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আন্তরিক বাংলাদেশ। তবে, অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ভুলে যায়নি ঢাকা। বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা, ১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেওয়া বৈদেশিক সহায়তার পাওনা পরিশোধের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি।
ইসহাক দারের সফরে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ঢাকার পক্ষ থেকে তোলা হবে কি না- জানতে চাইলে এক কূটনীতিক বলেন, এগুলো ইস্যুর অংশ। কোনটা তুলবে, কোনটা তুলবে না সেটা নিয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। মোটা দাগে যা যা আছে সব থাকবে। এটা এত আগে থেকে বলা কঠিন, এখনো অনেক সময় বাকি।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে। তিনি বরাবরই বলে আসছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। আমরা মোটেই তাদেরকে এ প্রসঙ্গে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করিনি যে, একাত্তরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখব। ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই তৈরি করার চেষ্টা করব, সেখানে একাত্তরও থাকবে।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তান যদি এ সাহসটুকু দেখায়, এখানে ১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা উদ্ধৃত করে তারা যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এটা তো দোষের কিছু নয়।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালের জুলাইয়ে হিনা রাব্বানির আবার ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু হিনা রাব্বানি ঢাকায় আসেননি। সম্ভাবনা জাগিয়ে হিনা রাব্বানির সফর বাতিলের পর পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ভার্চুয়ালি ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন।
২০২১ সালে পাকিস্তানে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মন্ত্রী পর্যায়ের জরুরি বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। কিন্তু শেষ সময়ে তিনি সফরটি বাতিল করেন। তার বদলে বৈঠকে পাঠানো হয় তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে। এর বাইরে ২০২২ সালের মার্চে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে ইসলামাবাদে দুই দিনব্যাপী ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনিও সফরে না গিয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিবকে পাঠান।
পাকিস্তানে বাংলাদেশের সাবেক এক হাইকমিশনার বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে হবে। বিগত সরকারের সময়ে ২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু এরপর আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছি। বিশেষ করে বিগত সরকারের শেষ সময়ে। আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে পারি, পাকিস্তানের সঙ্গেও।
পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক বিবেচনায় অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের এখনই উত্তম সময় জানিয়ে এ হাইকমিশনার বলেন, আমাদের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু আছে। আমরা চাইলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বিষয়টি সমাধান করতে পারি। সংকটের মধ্যে কিছু সুযোগ তৈরি হয়। এটি একটি সুযোগ এবং আমাদের তা কাজে লাগাতে হবে।
কেএন/টিএ