বলিউড অভিনেত্রী রেখার জীবন নানা কারণেই ছিল বৈচিত্র্যময়। মা ছিল, কিন্তু বাবার স্বীকৃতি ছিল না। অভিনয়ে গিয়ে কিশোরী বয়সে জোরপূর্বক চুমুর কবলে পড়েন। খুব বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে যাত্রা শুরু হয় রেখার।
অভাব থেকে অভিনয়ে আসা এই অভিনেত্রীর জীবনজুড়েই ছিল সংগ্রাম।
ছিল না বাবার স্বীকৃতি
বলিউড অভিনেত্রী রেখা আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রেখা নেহাতই পেটের দায়ে চলচ্চিত্রে নেমেছিলেন। নিজের জন্য, সংসারের জন্য।
মা-বোনদের জন্য। রেখার ছিল জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ। গত শতকের ৫০ দশকের মাঝামাঝি। সে সময়ের পরিচিত তামিল অভিনেতা জেমিনি গণেশন ও তেলেগু অভিনেত্রী পুষ্পাভ্যালির ঘরে ভানুরেখা গণেশন ওরফে রেখার জন্ম ১৯৫৪ সালে।
তবে রেখার মায়ের ছিল না বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি। সে কারণেই রেখার জন্মের পর বাবার স্বীকৃতি মেলেনি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে জন্য রেখাকে বিভিন্ন সময়ে শুনতে হয় নানা কটু কথা। বাবা জেমিনিও রেখার ছোটবেলায় তাঁকে সন্তান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। কেননা জেমিনির ছিল অসংখ্য সম্পর্ক ও বাচ্চা।
একমাত্র তাঁর স্ত্রী ছিল ববজি। পিতৃপরিচয়ের সংকট নিয়ে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে আসেন রেখা। হার মানেননি; বরং স্বপ্ন দেখতেন বিমানবালা হওয়ার। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে পরিবারে দারিদ্র্য নেমে আসে।
অভাবে অভিনয়ে
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রেখা হয়ে ওঠেন তাঁর ছয় সদস্যের পরিবারের কাণ্ডারি। কিশোরী রেখা পরিবারের হাল ধরেন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এই নারী নিজেই বলেছেন, ‘বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম আমার ভাই-বোনদের মা, এমনকি আমার মায়েরও মা।’ মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করতে হয় রেখাকে। কেননা তাঁর মা তাকে দুটি অপশন দিয়েছিলেন, এক. কাজ করতে হবে, দুই. অভিনয় করতে হবে। অভিনয়কেই বেছে নিলেন রেখা।
কিশোরী রেখা ঠিক করেন বলিউডে নেমে পরিবারের অভাব দূর করবেন। অডিশন দিতে লাগলেন। কিন্তু রেখা ছিলেন কৃষ্ণকলি, কালো তাঁর গায়ের রং। গায়ের রং ফর্সা ছিল না। তখন বলিউডে নায়িকা হতে গেলে প্রথম শর্ত, ফর্সা হতে হবে। আবার হিন্দিও জানতেন না একেবারেই। তাই প্রযোজক-পরিচালকেরা ফিরিয়ে দিতে থাকেন তাঁকে।
তবে শ্যাম বেনেগাল রেখাকে দেখে, তাঁর অভিনয়শৈলী দেখে বুঝতে পারলেন এই মেয়ের দ্বারা হবে। তখন বয়স মাত্র ১৩-১৪ রেখার, কিন্তু অভিনয় মুগ্ধ করল শ্যাম বেনেগালকে। প্রথম চলচ্চিত্রে পারিশ্রমিক পেলেন ২৫ হাজার টাকা।
চলচ্চিত্রে নেমেই বিপাকে
১৯৬৯ সালে ‘গোয়াদাল্লি সিআইডি ৯৯৯’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তাঁর ভ্রমণ শুরু। তার আগে অবশ্য রেখা ১৯৬৬ সালে তেলুগু চলচ্চিত্র ‘রাঙ্গুলা রত্নম’ এ বেবি ভানুরেখা নামে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭০ সালে ভানু রেখা গণেশন অভিনয় করেছিলেন বলিউডের ছবি ‘শাওন ভাদো’তে। ওই বছরই প্রথম হিন্দি ছবি ‘আনজানা সফর’-এ সুযোগ মেলে তাঁর; কিন্তু কপাল ফেরেনি। সে ছবি মুক্তি পেতে কয়েক বছর লাগে।
প্রথম দিকে মুক্তি না পাওয়ার জন্য দায়ী না হলেও কারণ রেখাই। ‘আনজানা সফর’ ছবিটি ওই সময় সেন্সর বোর্ডে আটকে যায়। কারণ, সহশিল্পী বিশ্বজিতের সঙ্গে কিশোরী রেখার পাঁচ মিনিটের দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্য।
তখন তিনি ১৫ বছরের কিশোরী। রেখার নায়ক ছিলেন বিশ্বজিৎ। ছবিতে একটি চুমুর দৃশ্য ছিল। বিশ্বজিৎ নাকি জোর করে অনেক সময় ধরে রেখাকে চুমু খেয়েছিলেন। আর এতে স্তম্ভিত হয়ে যান নায়িকা। কোনো কথা না বলে রেখাকে টানা পাঁচ মিনিট ধরে চুমু খেয়েছিলেন তিনি। ছবির কলাকুশলীরা সবাই চারপাশ থেকে চিৎকার করছিল এবং চটুল মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল তাঁদের উদ্দেশে। আর রেখার দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছিল জল। কী ভয়ংকর ছিল ১৫ বছরের কিশোরীর ওই মুহূর্ত। পরে অবশ্য বিশ্বজিৎ দাবি করেছিলেন, গোটা ঘটনাটি পরিচালকের আইডিয়া ছিল।
শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতন
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল রেখার জীবনে। বিয়ের দিনেই শুরু হয়েছিল সেই নির্যাতন। কলকাতায় বিনোদ মেহেরাকে বিয়ে করার পর মুম্বাই যান নায়িকা।
কিন্তু বিনোদের মা কমলা মেহেরা ছেলের বউ হিসেবে রেখাকে মেনে নেননি। প্রতিবেশীদের সামনে অপমান করা হয় তাঁকে। এমনকি, জুতো ছুড়েও মারা হয় বলে রেখার অভিযোগ।
রেখার দ্বিতীয় স্বামী মুকেশ আগারওয়ালের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিচ্ছেদ ও মুকেশের আত্মহত্যার ঘটনাও উঠে এসেছে বইটিতে। রেখার ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস নেওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনাটি মনে দাগ কেটেছিল সবারই। সুভাষ ঘাইয়ের মতো পরিচালক বলেছিলেন মুকেশের আত্মহত্যার ঘটনাটি বলিউডকে কলঙ্কিত করেছে। এরপর বলিউড নায়িকাদের কেউ আর ঘরের বউ করতে চাইবে না।
নিজে বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি রেখার কারণে অনেকই বিব্রত হয়েছেন নানা সময়ে। ১৯৮০ সালে নিতু সিং ও ঋষি কাপুরের বিয়ের অনুষ্ঠানে সিঁদুর ও মঙ্গলসূত্র পরে উপস্থিত হয়ে হইচই বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেদিন সবাই প্রশ্ন তুলেছিল, রেখা কি বিয়ে করেছেন? সে সময় সদ্য বিবাহিতা অমিতাভ বচ্চন ও জয়া বচ্চনের সঙ্গে নিজ থেকে গিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। এ সময় অমিতাভের কথিত প্রেমিকা হিসেবে জয়ার মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ান রেখা।
অভিনেত্রী রেখা
১৯৭০-এর দশকে তিনি যে ১০০ সিনেমা করেছিলেন তা হয়তো অনেকের মনে নেই, কারণ তার সেসব সিনেমা খুব কম সফল হয়েছিল। তখন তিনি ‘বি’ গ্রেডের চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি তারকা স্ট্যাটাসে পৌঁছেছিলেন। তিনি এ ধরনের স্টারডমে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন এবং প্রযোজক এবং পরিচালকরা তার খ্যাতির জন্য তাকে নিতে বাধ্য হন।
রেখা সম্ভবত বলিউডের প্রথম অভিনেত্রী যিনি ‘নারীকেন্দ্রিক’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বড় তারকা হয়ে উঠেছিলেন, তাই এটি তার প্রায় ১০ বছরের লড়াই ছিল। তার স্বামী মুকেশ আগরওয়ালের আত্মহত্যার পর, তিনি খুন ভারি মাংয়ে অভিনয় করেন। এটি সেই বছরের বিশাল হিট ছিল। রেখা ছাড়া আর কারো পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। এরপর তিনি কেসি বোকাদিয়ার প্রতিশোধমূলক ফুল বানে আঙ্গার করেন, যা আবারও বাণিজ্যিকভাবে হিট চলচ্চিত্র ছিল।
এমকে/টিকে