জিল্লুর রহমান

সম্পর্ক পুনর্গঠন চাইলে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতেই হবে

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টিভি উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই অদ্ভুত অদ্ভুত এক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে ১৯৭১ সালের গভীর ক্ষত। অন্যদিকে রয়েছে আঞ্চলিক বাস্তবতা ও পারস্পরিক কৌশলগত প্রয়োজন।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দীর্ঘ ক্ষমতাকালে দুদেশের সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে গেছিল।

সেই সময় ঢাকার কূটনীতি ছিল অনেকটা একমুখী। দিল্লিকে প্রধান বিদ্রোহ হিসেবে দেখা। ইসলামাবাদকে উপেক্ষা করা। এমনকি শত্রু হিসেবে আচরণ করা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানের অপরাধের প্রশ্নটি প্রায় একমাত্র ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের আগমনের পর পরিস্থিতি নতুন এক মোড় নিয়েছে।’

বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) ইউটিউবের এক ভিডিওবার্তায় জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর একটা বড় রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। ইসহাক দারের এই সফরে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে।

সই হয়েছে ছয়টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক। এর ভেতর রয়েছে বাণিজ্য নিয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, ফরেন সার্ভিস একাডেমির সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস ও এপিপির মধ্যে অংশীদারি এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পাকিস্তানের আইএসএসআই-এর সহযোগিতা। যদিও ভিসার চুক্তিটি কেবল সরকার ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য সীমিত। তারপরও তা প্রতীকী অর্থে সম্পর্ক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।

তবে এই সফরের প্রকৃত আলোচ্য বিষয় ওঠে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দাবি করেছেন যে ১৯৭১ সালের বিষয়টি দুইবার মীমাংসা পেয়েছে।

প্রথমবার ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে। দ্বিতীয়বার ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফের বক্তব্যের মাধ্যমে। তখন তিনি ঢাকায় এসে নৃশংসতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। সেটিকে ইসলামাবাদ চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হিসেবে দেখতে চায়।

কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আজ পর্যন্ত কোনো পাকিস্তানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল, কিন্তু তা ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয়; ভুট্টুসহ রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণহত্যার জন্য দায়ী ছিল। সুতরাং মীমাংসা হয়ে গেছে দাবি করা আসলে ইতিহাসের প্রতি একটা বড় অবিচার।

ইসহাক দারের মন্তব্যে পরিবার ও ভ্রাতৃত্বের উদাহরণ বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ ১৯৭১ সালের ঘটনাকে কোনো পারিবারিক দ্বন্দ্ব বলা একেবারেই অসমীচীন। এটা ছিল এক পরিকল্পিত গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনারা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে। কোটি মানুষকে শরণার্থী করেছে। সেই স্মৃতি এখনো বাংলাদেশের জাতীয় চেতনায় জীবন্ত। কাজেই সম্পর্ক পুনর্গঠন চাইলে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতেই হবে।

তবুও বাস্তবতা ভিন্ন এক সত্য সামনে আনে। বাংলাদেশ আজ ভারতের সঙ্গে ক্রমশ অস্বস্তিকর সম্পর্কে আটকে পড়েছে। সীমান্তে পুশ ব্যাক, নাগরিকত্ব প্রশ্ন, অর্থনৈতিক চাপ—এসব নিয়ে দিল্লির সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ছে। অন্যদিকে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এক ধরনের কূটনৈতিক ভারসাম্য দিতে পারে বলে কোনো কোনো মহল মনে করে। একই সঙ্গে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে যে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা কাঠামো তৈরি হয়েছে সেটা কৌশলগতভাবে কারো কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটার একটা বিপরীত দিকও আছে, ঝুঁকিও আছে। সেটাও আমাদের মাথায় রাখা দরকার। ভারতকে অচল করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ বন্দর ব্যবহার আঞ্চলিক বাণিজ্যের মতো ক্ষেত্রগুলোতে ইসলামাবাদ-ঢাকার সহযোগিতা কারো কারো মতে নতুন একটা সুযোগ তৈরি করতে পারে। 

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্র: লিগপর্বেই মুখোমুখি রিয়াল, পিএসজি ও বার্সা Aug 29, 2025
img

গাজীপুরে লাইনচ্যুত কোচ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক Aug 29, 2025
img
জাসদ সভাপতির ভাইকে ‘সমাদর’, থানার তিন কর্মকর্তা বদলি Aug 29, 2025
img
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামলেন ফেডারেল রিজার্ভ গভর্নর Aug 29, 2025
img
শিবির ট্যাগ দিয়ে বিতর্কে, দুঃখ প্রকাশ করলেন ডাকসু এজিএস প্রার্থী মায়েদ Aug 29, 2025
img
দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইলেন বেগম খালেদা জিয়া Aug 29, 2025
img
৫৬৪ কেজি পাঠ্যবই বিক্রি, প্রধান শিক্ষক ও ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার Aug 29, 2025
img

দাবি ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশিরের

শিক্ষার্থীর মুখ চেপে ধরা ছবিটি আসল, পুলিশের দাবি মিথ্যা Aug 29, 2025
img
স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া Aug 29, 2025
img
লিবিয়ার ডিটেনশন থেকে দেশে ফিরছে ১৬১ বাংলাদেশি Aug 29, 2025
img
বাণিজ্য শুল্ক ঘিরে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র Aug 29, 2025
img
মৌলিক সংস্কার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না : গোলাম পরওয়ার Aug 28, 2025
img
লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা Aug 28, 2025
img
স্বর্ণজয়ী ফাতেমা মুজিব ছাড়াই শুরু হচ্ছে ফেন্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ Aug 28, 2025
কালো-সোনালি পোশাকে জয়া, ঝলকে উঠল সৌন্দর্য! Aug 28, 2025
সুরা ফাতেহা নতুনভাবে আবিষ্কার Aug 28, 2025
img
জাতীয় দলের প্রস্তুতিতে যোগ দিতে আরব আমিরাতে রশিদ Aug 28, 2025
img

জিল্লুর রহমান

সম্পর্ক পুনর্গঠন চাইলে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতেই হবে Aug 28, 2025
img
যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিলো রাশিয়া Aug 28, 2025
img
মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে কেউ পার পাবে না : প্রিন্স Aug 28, 2025